Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

Icon

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৯

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

গত ১৬ বছর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চরম অপব্যবহারসহ এমন কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নেই, যা হয়নি। ফলে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি তুলেছেন। এর কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চার পথকে প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কার্যকর ফল দিতে পারে। অনেকে এও মনে করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক শাসন ষোলো আনা প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে অন্তত এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদব্যবস্থার চেয়ে তা অধিকতর সুফল  দিতে পারবে। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের বিকাশে এই দুই পদ্ধতির অবদান ও অবস্থান নিয়ে কিঞ্চিত বিশ্লেষণ করা যাক।

সংসদ ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ইতিহাস বিশ্বে বেশ পুরোনো। আদি জনগোষ্ঠীগুলোতে তাদের গোত্রপতি বা বয়োজ্যেষ্ঠরা সমষ্টিগত ভালো-মন্দের স্বার্থে নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় আলোচনা সাড়তেন। এখনো সব দেশে এটির নাম পার্লামেন্ট নয়, কোথাও সিনেট, কোথাও দ্যুমা, কোথাও মজলিস-এ-শুরা, কোথাও নেসেট। নাম যাই হোক, জায়গাটি যে কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার জন্য নির্ধারিত, তা সর্বপরিসরেই সর্বৈব সত্য। আর রাষ্ট্রের গতি নির্ধারণের জন্য এই কথাবার্তাগুলো যে সুচিন্তিত হতে হয়, সেখানে যে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির উত্তম পরামর্শও দেওয়া হয়, তা বলাই বাহুল্য। ফলে যেকোনো দেশের সংসদ সে দেশের প্রধান আইন প্রণয়নকারী সংস্থাও বটে। একটি দেশের পার্লামেন্ট এক কক্ষবিশিষ্ট কী দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে, সেই বিতর্কও এসব কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনাকে সংসদে কত বেশি ফলপ্রসূ করা যাবে এবং তা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আইনি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নে কতখানি কার্যকর করা যাবে, সেই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল, সেখানেও যে সংসদের অস্তিত্ব ছিল, তা ডেনিশ ঐতিহাসিক থরকিল্ড জ্যাকবসন লিখেছেন, ‘নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ’ জার্নালে সেই ১৯৪৩ সালে। 

এসবই সংসদের স্থানভেদে নাম, তাদের উৎপত্তি ও বিবর্তনের কিঞ্চিৎ ইতিহাস। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ইতিহাস খুব বেশি পুরাতন নয়, আবার খুব নবীনও নয়। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ১৩৪১ সাল থেকে সাধারণ সভ্যরা ধর্মবেত্তা ও সম্ভ্রান্তদের সঙ্গে এবং নাইট ও বার্গেসদের সঙ্গে আলাদা করে সাক্ষাৎ শুরু করেন। সাধারণ সভ্য, ধর্মবেত্তা ও সম্ভ্রান্তদের মিলনকক্ষকে বলা হতো নিম্নকক্ষ এবং তাদের সঙ্গে নাইট ও শহরবাসী বা বার্গেসদের মিলনকক্ষকে বলা হতো উচ্চকক্ষ। ২০০ বছর পর ১৫৪৪ সালের পর থেকে সাধারণ সভ্যদের মন্ত্রণাকক্ষ বা নিম্নকক্ষকে হাউস অব কমন্স এবং নাইট ও বার্গেসদের সঙ্গে মিলিত হয়ে শলাপরামর্শের কক্ষ বা উচ্চকক্ষকে হাউস অব লর্ডস বলে ডাকার চল শুরু হয়। যদিও শুরুতে ব্রিটেনে এই ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল সামাজিক স্তরভিত্তিতে মন্ত্রণাদান ও মন্ত্রণা গ্রহণের জায়গা থেকে, কিন্তু পরবর্তীতে এর কিছু সুফল পাওয়া যায় বলে এটি আজও অনেক দেশে টিকে আছে। প্রথমত, দুটি কক্ষ সক্রিয় থাকে বলে শ্রমবিভাজিত হয়; ফলে বিল খুঁটিয়ে দেখার অবকাশ থাকে। তবে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, রোমানীয়া প্রভৃতি দেশে উচ্চকক্ষের নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে ভেটো প্রদানের অধিকার আছে। যদি দ্বিতীয় কক্ষকে ফ্যাসিস্ট সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে গণ-আকাঙ্ক্ষা টুঁটি সে এই প্রক্রিয়ায় চেপে ধরতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থায় বিল দুটি কক্ষ পার হয়ে আইন প্রণীত হয় বলে নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে আইনটি পরিশীলিত হয়। নির্বাহী বিভাগ আইন প্রণয়নকে তার সুবিধামতো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে দুটি কক্ষকে একই সঙ্গে করা দুরূহ। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে নির্বাহী বিভাগই বেশি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থার আরো যেসব সুবিধার কথা বলা হয় তা তর্কসাপেক্ষ। বলা হয়, দ্বিতীয় কক্ষটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে। যদি ধর্মীয় মৌলবাদী সরকার ক্ষমতায় যায় বা একনায়কতন্ত্র ক্ষমতায় জেঁকে বসে তবে এসব যুক্তি একেবারেই খোঁড়া।  তৃতীয় সাম্রাজ্য বা থার্ড রাইখের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফ হিটলার কিন্তু তার নাৎসি দল নিয়ে ১৯৩৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবেই সরকার গঠন করেছিল। পরবর্তী ইতিহাস এবং হলোকাস্ট অধ্যায়, অ্যান্টিসেমিটিজম, ইহুদি নিধন ও তথাকথিত আর্য জাতিতত্ত্বের ফাতরামোর বিষয়ে আমরা সবাই সবিশেষ অবহিত। বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের একই রকম মুসলিম বিদ্বেষী নীতি ও বাংলাদেশকে বাগে আনার জন্য এ দেশকে উপনিবেশীকরণের প্রক্রিয়ার শুরু এভাবেই। সেই সঙ্গে তারই পরিণতিতে অগণতান্ত্রিক হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এবং জনস্বার্থবিরোধী কাজে মদদদান একই সূত্রে গাঁথা। নিরপেক্ষভাবে বললে, হাসিনা সরকারের সব অপকর্মের দোসর যে ভারত বা মোদি সরকার, তা নয়। কিন্তু এই অবৈধ সরকার ভারতের মদদে টিকে যাওয়ার কারণেই বাকি অপকর্মগুলো করতে পেরেছে। 

১৯২৪ সালের জুলাই গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনা পলায়নের আগ পর্যন্ত সে ভারতের মদদেই টিকে ছিল। সে যে ভারতের সহায়তায় অগণতান্ত্রিকভাবে টিকে ছিল এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সে দেশেই পলায়ন। যত মতপার্থক্য থাকুক, তাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মোদি সরকার এবং কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীর সুর একই। আশার কথা হচ্ছে ভারতে কিছু বুঝদার জনগোষ্ঠী আছে, তাদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে তারা বোঝেন। অনেকে যে বোঝেন না, সে দোষ তাদের নয়। তারা সঙ্ঘবদ্ধ ভারতের মিডিয়া ক্যুর শিকার। ফলে এসব ক্ষেত্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদও কিছুই করতে পারে না। যেমন ভারতের গণতন্ত্র যেকোনো হিসাবেই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, সমস্যা হচ্ছে তার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি নিয়ে। সে তার নিজের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে হয়তো সচেতন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সে যে নিজস্বার্থে অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে ও তাকে টিকিয়ে রাখতে পারে, তার প্রমাণ হাসিনা সরকার। ভারতের অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশের এই সরকার পতনে পরাশক্তি ও কিছু ধর্মীয় দলের মদদ থাকতে পারে। আমি বলেছি, আপাতত সে যুক্তি মেনে নিলেও প্রথমে যে জন-অসন্তোষ সর্বাত্মকভাবে দেখা দিয়েছিল, তার কী হবে? আমি বলেছি, আপনারা ডেলিগেশন ও তদন্তকারী দল পাঠান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি এই কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তবে কি ভারতীয় সংবাদপত্র ও মিডিয়াগুলো তা প্রচার করবে? তারা উত্তর দেননি। 

এই সমস্যা শুধু ভারতের নয়, সব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ক্ষেত্রেই এই সত্য প্রকটিত। নিজ দেশে তারা গণতন্ত্র চর্চা করেন, ক্ষুদ্র ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোতে তারা অগণতান্ত্রিক কিন্তু স্বপক্ষের সরকারকে জিইয়ে রাখেন। সে ক্ষেত্রে ওই দেশগুলোতে তারা প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বৃত্তায়নের পরিবেশ তৈরি করেন। অনেক সময় দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার তার টিকে থাকবার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে সহজে বশ্যতা স্বীকার করে। ফলে দুর্বৃত্তায়নের বৃত্তের পরিধি বৃহত্তর হয়। বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর প্রজেক্ট তার অন্যতম। আমি বাংলাদেশ সরকারকে বলব, কোনো লুকোচুরি না করে ভারতের কিছু গণমাধ্যমের কাছে তথ্য প্রদান করুন, যাতে তারা সে দেশের জনগণের কাছে বিষয়গুলো পেশ করতে পারেন। 

মোদি সরকার যেমন চূড়ান্ত কথা নয়, হাসিনা সরকারও নয়, এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা কোনো সরকারই নয়। এ দেশের বা ভারতের জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ না করলে, তাদের অন্ধ করে রাখলে সবাইকে বিদায় নিতে হবে। আর এই বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে কক্ষ বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তৃকক্ষবিশিষ্ট সংসদও গঠিত হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী পিটার ভিলেম বোথার নেতৃত্বে। এর ভালো দিকও ছিল। সংবিধান সীমিত আকারে হলেও কালো ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল। এটি বর্ণবাদী অ্যাপারথেইড আইনকে (Apartheid legislation) কার্যকরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই আইনকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে কালো ও অশ্বেতাঙ্গদের দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপক সংগ্রামে লিপ্ত হোতে হয়। পরে একজন শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতি ফ্রেডেরিক ভিলেম ডি ক্লার্ক মানবজাতির জাতির জন্য অসম্মানজনক এই আইনকে উৎপাটন করেন।

ইরানের সংসদ এক অর্থে বলা চলে ত্রিকক্ষবিশিষ্ট। ‘মাজলেস এ সুরা এ এসলামী’ বা ইসলামিক কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলি এবং গার্ডিয়ান কাউন্সিল হলো প্রথম দুটি কক্ষ। দ্বিতীয় কক্ষ প্রথম কক্ষের সিদ্ধান্তে ভেটো দিতে পারে। আর এসব কিছুর ওপর আছেন সম্মানিত প্রধান ধর্মীয় নেতা, যাকে বলা হয় ‘রাহবার এ মুয়াজ্জাম এ এনকেলব এ এসলামী এ এরন’। কিন্তু ২২ বছরের তরুণী মাশাহ আমিনীর মৃত্যু ও হেজাব বিষয়ে সরকার খুবই অদূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছে। যদি পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বে ইরানের তথৈবচ অবস্থা হয়, যেটি বর্তমান শিয়াপন্থি সরকারকে সমর্থনকারীরা বলে থাকেন, তাহলেও আমার উপরোক্ত কথাগুলো ঠিক। রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ যদি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল না হয়, তা যদি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর নানা আকাক্সক্ষা ও কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য আর এক কক্ষ, দ্বিকক্ষ বিতর্ক কিছুটা দরকারি হলেও খুব একটা দরকারি বিতর্ক নয়। বাড়িরই যখন ভগ্নদশা, তখন কক্ষ বাড়িয়ে আর কী হবে?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫