Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

তারেকের দেশে ফেরা, নির্বাচন ও বিএনপির শঙ্কা

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৩৭

তারেকের দেশে ফেরা, নির্বাচন ও বিএনপির শঙ্কা

সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা চারটি মামলা বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় যেদিন (৫ জানুয়ারি) আপিল বিভাগও বহাল রাখলেন, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ লন্ডন থেকে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘তারেক রহমানের দেশে ফেরার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।’ তবে তিনি এও বলেছেন যে, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই আলোচনায় আছে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি। তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর সাজা বাতিল হচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় দলের সিনিয়র নেতারাও বলছিলেন, শিগগিরই দেশে ফিরবেন তিনি। কিন্তু সেই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। বললেন, এখনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। পরিবেশ বলতে তিনি কি আইনি জটিলতার কথা বলছেন, নাকি অন্য কিছু?

তবে শুধু তারেক রহমানের দেশে ফেরার ইস্যুই নয়, বরং সাম্প্রতিক রাজনীতি, বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি শুরু থেকেই তাদের উদ্বেগের কথা বেশ খোলামেলাই বলছে। নেতাদের কথায় মনে হচ্ছে, সরকার প্রথমত নির্বাচনটি বিলম্ব করতে চায় এবং দ্বিতীয়ত, বিএনপি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেই চেষ্টা হচ্ছে। যে কারণে দেখা যাচ্ছে, তারেক রহমান এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অনেক সিনিয়র নেতাই বারবার বলছেন : ষড়যন্ত্র চলছে।

বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিলম্বিত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার মাধ্যমে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। 

বিএনপি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাদের ধারণা, এই প্ল্যাটফর্মের কিছু কার্যক্রম বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। সার্বিকভাবে, বিএনপি মনে করছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু মহল তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং তারা এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে।

তারেক রহমান নিজে অবশ্য ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের ‘দোসরদের’ দিকেই ইঙ্গিত করছেন। সম্প্রতি একাধিক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে এবং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।’

তারেকের ফিরতে বাধা কোথায়?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, নাশকতা, গ্রেনেড হামলা ও দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ৮০-৮২টির মতো মামলা করা হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। পাঁচটি মামলায় তার দণ্ড হয়। এর মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় গত পয়লা ডিসেম্বর তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। সম্প্রতি আরো চারটি মামলায় তাকে অব্যাহতি দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এর আগে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দেন আদালত। তার মানে দেশে ফিরতে তার খুব বেশি আইনি জটিলতা নেই। 

রাজনৈতিক মহলে এ রকম আলোচনাও আছে যে, তারেক রহমান যেদিন দেশে আসবেন, সেদিন থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাবে। তিনি মূল ফোকাসে চলে আসবেন এবং তখন দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির তরফে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। তাতে করে সরকার যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেগুলো ব্যাহত হবে বা মাঝপথে আটকে যাবে। এসব কারণে সরকার হয়তো এখনই তার দেশে আসার বিষয়ে গ্রিন সিগনাল দিতে চায় না। কিন্তু সরকার যেসব সংস্কার করতে চায়, সেগুলো শেষ করতে কতদিন লাগবে বা সত্যিই কতটুকু সংস্কার করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কেননা যারা এসব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি প্রশ্ন আছে তাদের ইনটেনশন বা নিয়ত নিয়েও। মূলত এসব কারণেই বিএনপির মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ হয়তো কাজ করছে।

বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এজেন্ডা বা অগ্রাধিকার জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যার বিচার, সেটি তারা এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে। তাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার সংস্কার। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য তারা যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার ফলে সত্যিই কতটুকু সংস্কার হবে বা বিদ্যমান সিস্টেমে কতটুকু পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় বিএনপিও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। যদিও সরকার এবং তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডাররা মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। অর্থাৎ নির্বাচনের দিনক্ষণ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য এখন বেশ দৃশ্যমান।

এ বিষয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমতের সুযোগ কম যে, অনির্বাচিত বা নির্দলীয় সরকারের পক্ষে খুব বেশি সংস্কার বা পরিবর্তন করা কঠিন। তা ছাড়া জনগণের কাছে সংস্কারের চেয়েও বড় বিষয় যেহেতু তার স্বস্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা, ফলে বিচার বা সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ হলে এবং তার বিপরীতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অধিকতর নাজুক হতে থাকলে এবং রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিভাজন বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আরো বেশি ঘোলাটে হবে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের অংশীদার এবং সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে ঐকমত্য গড়ে তোলা না গেলে আখেরে তার মধ্য দিয়ে দেশ একটি সংকট থেকে আরেকটি সংকটে নিপতিত হবে, যা কারোরই কাম্য নয়।

নির্বাচন কবে 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে, এটিই এখন দেশের প্রধান আলোচনা। সব মিলিয়ে জনমনে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে হয়তো ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

সরকার যে আগামী বছরের মাঝামাঝি কিংবা চলতি বছরের শেষে নির্বাচন দিতে চায়, সেটি বিভিন্ন সময়ে বলেছে। সবশেষ গত ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ সংসদ সদস্য রূপা হককে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য দুটি সময় বলেছেন। এর একটি হলো আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি। ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচনের সময়সূচি নির্ভর করছে জনগণ কতটুকু সংস্কার চায় তার ওপর। তবে তিনি এও নিশ্চিত করেছেন যে, আগামী নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।

কিন্তু বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানাচ্ছে। মূলত এই ইস্যু নিয়েও তাদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে এবং আগামী মার্চের পরে এই ইস্যুতে বিএনপি রাজপথে আন্দোলনে নামতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। তখন এই ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে বিএনপির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না এবং হলে সেটি নতুন করে সংকট তৈরি করবে কি না, জনমনে সেই শঙ্কাও রয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫