
পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ অনেক আগে থেকেই বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বিভিন্ন সময়ে একে কোণঠাসা করার ম্যালা চক্রান্ত হলেও বাঙালির আবেগের কাছে ওসব ধোপে টেকেনি। এখন পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃত।
বাঙালির দ্বিতীয় সর্বজনীন উৎসব পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন। দেশজুড়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হলেও একে পাদপ্রদীপের আলোয় আনার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ ছিল না। কিন্তু পুরোনো ঢাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে এটি সাড়ম্বরে উদযাপন করে আসছে। পিঠা খাওয়া ও ঘুড়ি উড়ানো- এই দুই হচ্ছে পৌষসংক্রান্তির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এখন প্রয়োজন এতে প্রাতিষ্ঠানিক সাহচর্য। তাহলে দেশজুড়ে এর বিস্তৃতি সহজেই সম্ভব। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে জমজমাট পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসব দেশজুড়ে স্বল্পসময়ের নোটিশে পালন করা সম্ভব। বাঙালি মাত্রই পিঠাপ্রিয় আর ঘুড়ি উড়ানো দেশের মানুষের নির্মল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। কাজেই দেশজুড়ে কম খরচে এই উৎসব আয়োজন সম্ভব। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এর আগে দেশব্যাপী জাতীয় পিঠা উৎসবের আয়োজন করে ভালো সাড়া পেয়েছে। অতএব, এ ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বর্তমানে পুরোনো ঢাকায় সাকরাইন উৎসব সর্বজনীন ঢাকার উৎসবে রূপ নিয়েছে। সারা দিন ঘুড়ি উড়ানো, বাড়িঘর ও ছাদে জমকালো আলোকসজ্জা, আগুন নিয়ে খেলা, সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও ফানুসে ছেয়ে যায় পুরান ঢাকার আকাশ। ঐতিহ্যবাহী ‘সাকরাইন’ উৎসব পৌষসংক্রান্তি ও মাঘ মাসের শুরুর প্রথম প্রহরে উদযাপিত হয়। সেই হিসেবে প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারি নানা আয়োজনে পালিত হয়। এক হয়ে যায় সংক্রান্তি ও সাকরাইনের পিঠা।
সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রাণ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ হলো বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করা হয়। বাংলায় দিনটি পৌষসংক্রান্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মকরসংক্রান্তি নামে পরিচিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৪০ সালের এই দিনে মোগল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বর্তমানে এটি একটি অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব বিশ্বব্যাপী ভীষণ জনপ্রিয়। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসবটি এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। উড়ানো ঘুড়িগুলো আকারে অনেক বড় আর দেখতে খুব বিচিত্র। উৎসবের সময় যত মানুষ হাজির হয় ঘুড়ি উড়াতে, তার চেয়ে বেশি মানুষ আসে শুধু দেখতে।
উপযুক্ত বাতাস, সূর্য, মনোরম জায়গা, খাবার সব কিছুর সমন্বয়ে ইতালির সারভিয়ার এই ঘুড়ি উৎসবটি সারা বিশ্বেই খ্যাতি পেয়েছে। এখানকার ঘুড়িগুলোতে দেখা যায় কিছুটা শিল্পের ছোঁয়া। ফ্রান্সের Dieppe শহরের ঘুড়ি উৎসবটিতে ঘুড়ি উড়াতে পুরো বিশ্ব থেকেই ঘুড়িপ্রেমিকরা হাজির হয়। আসলে নির্দিষ্ট কোনো ঘুড়ি উৎসব হয় না এখানে। সারা বছরই এখানে ঘুড়ি উড়াতে আসেন ঘুড়ি প্রেমিকরা। প্রতি বছর প্রায় আট হাজার ঘুড়িপ্রেমিক এখানে ঘুড়ি উড়াতে হাজির হয়। জাপানের ঘুড়ি উৎসবটি অন্য সব উৎসবের চেয়ে একটু আলাদা। উৎসবের সময় আকাশে দেখা যায় অসীম সংখ্যার ঘুড়ি, যা গুণেও শেষ করা যায় না! ঘুড়ি উড়ানোর সঙ্গে চলে গান, নাচসহ নানা অনুষ্ঠান। ঘুড়ি উড়ানো শেষে রাতভর চলে অনুষ্ঠান।
পুরান ঢাকায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সবাই অংশগ্রহণ করে এই উৎসবে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ সাজানো হয় নানা আলোকসজ্জায়। দুপুর হতেই শুরু হয় ঘুড়ি উড়ানো। আকাশে শোভা পায় নানা রং আর বাহারি আকৃতির ঘুড়ি। কে কার ঘুড়ির সুতা কাটতে পেরেছে, সেই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। সন্ধ্যা নামলেই পুরান ঢাকার আকাশ হাজার হাজার আতশবাজির আলোয় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে উড়ানো হয় রংবেরঙের ফানুস। আয়োজন করা হয় নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের। বাড়িতে বাড়িতে থাকে মজার সব খাবারের আয়োজন। শীতের পিঠাপুলি, মুড়ি-গুড় ও পায়েস পরিবেশন করা হয়। সাকরাইনে যোগ দিতে প্রতি বছরই অনেকে পুরোনো ঢাকায় ঘুরতে যায়। আয়োজনের বেশি আমেজ পেতে যেতে পারেন সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজার, গেণ্ডারিয়া, সদরঘাট, তাঁতিবাজার, হাজারীবাগ ও নবাবপুর।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পৌষসংক্রান্তি, মকরসংক্রান্তি, তিলুয়াসংক্রান্তি- এই দিনকে আখ্যায়িত করে থাকেন। পৌষ মাসের শেষদিনে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে এই সংক্রান্তিকে উত্তরায়ণসংক্রান্তিও বলা হয়। স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-‘দিনসংক্রমণে কৃৎস্নং দিনং পুণ্যম।’ অর্থাৎ সংক্রান্তি দিনের বেলা সংক্রমণ ঘটলে সব দিনই পুণ্যকাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কোনো ব্রত বা উপবাস করার আগে যেমন সংযম করে ব্রতাদি পালন করা হয় এবং কীর্তন শুরুর আগে যেমন অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়, তেমনি উত্তরায়ণকে সামনে রেখে পূর্ববর্তী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-পার্বণ এবং নামযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে থাকে। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত হওয়ার শুভলগ্নে পূজা-পার্বণের দ্বারা তাদের সন্তুষ্টির ক্রমে যাতে দেবধামে পৌঁছে পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে দেবগণের সহায়তায় ভগবৎধামে যাওয়ার সুকীর্তিটুকু অর্জন করা যায়; এই উদ্দেশ্যে দেবতাদের পূজা-পার্বণ করে তাদের অশেষ কৃপা লাভ করা।
মানুষ যা করতে পারে না, দেবগণ তা অতি সহজে করতে পারেন। তাই উত্তরায়ণ পদার্পণের শুভক্ষণে এবং দেবগণ জাগ্রত হওয়ার পুণ্যলগ্ন ব্রহ্মমুহূর্তে স্নানসমাপন পূর্বক আহ্নিক ক্রিয়াদি শেষে ফুল-তুলসী, সাধ্যমতো প্রসাদি নিবেদনপূর্বক যজ্ঞ, পূজা, প্রার্থনা, অতিথিসেবা ইত্যাদির মাধ্যমে ভগবৎধামে যাওয়ার সুকীর্তিটুকু অর্জন করার চেষ্টা করা হয়। কারণ জীবের প্রকৃত ঠিকানা ভগবৎধাম।
সনাতনীরা বিশ্বাস করে, ভীষ্ম যদি দক্ষিণায়ণে দেহত্যাগ করতেন, তবে তাকে তার লোকে প্রবেশ করার জন্য বাইরে প্রতীক্ষা করতে হতো। তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন বলে ভেবে দেখলেন, দক্ষিণায়ণে মহাপ্রয়াণ করলে দেবলোকে গিয়ে বাইরে প্রতীক্ষা করার চেয়ে এখানে থেকে উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করাই ভালো।
ধর্মীয় অনুষঙ্গ যাই থাকুক না কেন পৌষসংক্রান্তিতে পিঠা প্রস্তুত করা হয় এবং তা বিলি করা হয় সবার মাঝে। পিঠার অনুষ্ঠান থাকে সবার জন্য উন্মুক্ত। অগ্রহায়ণ মাস ফসল কাটা ও ঘরে তোলার মাস। তাই নতুন ধানের চাল থেকে নানা আকার ও স্বাদের পিঠা তৈরি ও তা দিয়ে আপ্যায়ন লোকসংস্কৃতির পুরোনো অনুষঙ্গ। আর লৌকিক অনুষঙ্গ হিসেবে এতে যুক্ত থাকে ঘুড়ি উড়ানো। কোথাও কোথাও বড় আকারের প্রতিযোগিতা হয়।