Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র

Icon

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৪

আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্

১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ আসাদুজ্জামান। ৫৫ বছর পার হয়েছে, এখনো শহিদ আসাদের স্মৃতি আমাদের কাছে জাগরূক। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা কিছুটা বিস্মৃতিপরায়ণ, ফলে আপনজনদের ভুলে যাই। যারা আত্মত্যাগ করেছেন, রক্ত দিয়ে আমাদের জীবনকে সুন্দর ও মসৃণ করেছেন তাদের কথা ভুলে যাই। আজকে আসাদের নাম খুব কমই উচ্চারিত হয়, এর চাইতে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? শহিদ আসাদ সেদিন শহিদ না হলে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যেভাবে হয়েছে সেভাবে হতো কি না সন্দেহ। আর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল বলেই আইয়ুবের ১০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল। এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল হয়। এ জন্য আসাদের শাহাদাতবরণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

শহিদ আসাদ ছিলেন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং ইতিহাসের ছাত্র। সেই সময় যারা পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, বিশেষ করে পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), তাদের মধ্যে বিপ্লবের একটা নেশা পেয়ে বসেছিল। তারা অনেকেই মনে করতেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকাকে, দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষকে মুক্ত না করতে পারলে আমাদের জীবন সুখী-সমৃদ্ধিশালী হবে না, একটা সত্যিকারের স্বাধীন দেশ পাব না। এদের মধ্যে অনেকেই মার্ক্স-লেনিন-মাওসেতুঙের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই আদর্শের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন শ্রেণি আন্দোলন, শ্রেণি সংগঠন, শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে একটা সমাজে মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। তখন লক্ষ করা গেছে অনেকেই ছাত্রসংগঠনের কাজ শেষ করে হয় শ্রমিক অথবা কৃষক সংগঠন গড়ার কাজে চলে গেছেন। অর্থাৎ সকলেরই একটা প্রয়াস ছিল শ্রেণি সংগঠন গড়ে তোলার। 

শহিদ আসাদ এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য তার নিজ এলাকা নরসিংদীর হাতিরদিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী ১৯৬৮-এর ২৯ ডিসেম্বর সারা বাংলায় হাট হরতালের ডাক দেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনকে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া। শহিদ আসাদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা হাতিরদিয়ায় হাট হরতাল সংঘটিত করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। সেদিন পুলিশের গুলিতে তিনজন শহিদ হন হাতিরদিয়া হাটে। পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তিনি সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এড়ানোর জন্য ঢাকায় চলে আসেন। 

তখন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা মাত্র ঢাকায় এসে আসাদ অভ্যুত্থানে যোগ দেন। এ ব্যাপারে লেখক মাহফুজ উল্লাহ ‘অভ্যুত্থানের উনসত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ২০ জানুয়ারি, সোমবার, ১৯৬৯, সকালে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। হাজার হাজার ছাত্র লাঠিসোঁটা সহকারে উপস্থিত হয়। বক্তৃতার পালা শেষ হলে ফুলার রোড ধরে মিছিল বেরিয়ে পড়ে। শুরুতে মিছিলে কোনো পুলিশি হামলা হয়নি। শহিদ মিনার হয়ে মিছিল যখন চানখাঁরপুলসংলগ্ন রশিদ বিল্ডিং অতিক্রম করছিল, তখন পুলিশ বাধা দিলে মিছিল দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। প্রথম অংশ পুরোনো ঢাকার রাস্তা অতিক্রম করে শেষ হয় বাহাদুর শাহ পার্কে। ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়াগ্রুপ) অনুষ্ঠেয় সম্মেলনের অজুহাতে বাহাদুর শাহ পার্কে মেনন গ্রুপের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ঘোষণা করেন আন্দোলনের কর্মসূচি পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষণা করা হবে। অথচ এরা তখনো জানেন না মিছিলের শেষাংশের ভাগ্যে কী ঘটেছে। এখানে বলা প্রয়োজন, ওই সময় ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) তাদের জাতীয় সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং জানুয়ারি মাসেই তাদের সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। এই সম্মেলন হবে বলে তারা আন্দোলনে একটু ধীরগতিতে চলার কৌশল অবলম্বন করেছিল, যাতে তাদের সম্মেলনটা হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই জামাল হায়দার ঘোষণা করেন, আন্দোলনের কর্মসূচি পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করা হবে। রশিদ বিল্ডিংয়ের কাছে হামলা চালানোর পর কোনো সতর্কবাণী না দিয়েই পুলিশ গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলে মেনন গ্রুপের অন্যতম নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামান গুলিতে মারাত্মক আহত হন। গুলিতে আরো আহত হয়েছিলেন পাকিস্তান অবজারভারের স্টাফ ফটোগ্রাফার মোজাম্মেল হক (মরহুম), সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আবু, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আব্দুল মজিদ।

ছাত্ররা ধরাধরি করে আসাদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে নেওয়ার আগেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মুহূর্তের মধ্যে গোটা আন্দোলনের চেহারা পাল্টে যায়। ঘটনার প্রতিবাদে দুপুরের পর এক ঐতিহাসিক শোক মিছিল বের হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এ ছাড়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচিতে ছিল ২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার হরতাল, ২২ জানুয়ারি বুধবার শোক মিছিল এবং ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। 

শহিদ আসাদ

২০ জানুয়ারি, সোমবার কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যে শোক মিছিল বের হয় তাতে মেয়েরা নেতৃত্ব দেয়। সংবাদপত্র মন্তব্য করে, গৃহগুলোর ছাদ ও জানালা থেকে মিছিলকারীদের ওপর পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়। 

ওই দিনও পুলিশ ও ইপিআর কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ, বেয়নেট ও ব্যাটন চার্জ করে। ছাত্রীদের বেশির ভাগই ছিল ইডেন কলেজের ছাত্রী। তারা যাতে হরতালে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে জন্য পূর্বাহ্নেই কর্তৃপক্ষ ছাত্রী নিবাসের গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ছাত্রীরা সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের অনেককেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা নিতে হয়। এদের কেউ কেউ পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্রোতধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ রেখেছিল।

এখানে যে কথাটি বলতে চাই, ২০ জানুয়ারি আসাদুজ্জামান শহিদ হওয়ার পর যে মৌন মিছিল বের হয়, তা ঢাকা শহরে একটি শোকের আবহ তৈরি করে। কালো ব্যাচ পরা সেই মিছিলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একাত্ম হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়েই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যের সিঁড়ি রচিত হয়। এই দিক থেকে যদি বিবেচনা করি তাহলে অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে, শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং সময়কে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তা বিরাট প্রেরণাদায়ী হিসেবে কাজ করেছে।

শহিদ আসাদকে যেভাবে গুলি করা হয় সেটা আরো মর্মান্তিক। পুলিশের ডিএসপি বাহাউদ্দিন আসাদুজ্জামানকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে। ফলে তিনি নিহত হন। বাহাউদ্দিনের বিচার চেয়ে বহুদিন ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছিল, দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশ স্বাধীন হলো, সব কিছুই হলো, কিন্তু বাহাউদ্দিনের বিচারটাই হলো না। এভাবে অতীতেও যারা গণ-অভ্যুত্থান দমনে গুলি চালিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে, তাদের কারোরই কিন্তু শাস্তি হয়নি, বিচার হয়নি। কারণ একের পর এক যে সরকারগুলো এ দেশে এসেছে, তারা মূলত সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কাজ করেছে। আর পুলিশ বাহিনী বা অন্য যেসব বাহিনীর কথা আমরা জানি, তাদের কাজ ছিল সমাজ পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনকে দমন করা। এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এভাবেই তারা পুরোনো ঘুণে ধরা সমাজকে টিকিয়ে রেখেছিল। 

শহিদ আসাদের মৃত্যু আরেকটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত আমরা লক্ষ করি, গণ-আন্দোলনে ও গণ-অভ্যুত্থানে অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাদের মৃত্যু নিঃসন্দেহে তাৎপর্যহীন নয়; কিন্তু শহিদ আসাদের মৃত্যুটি ছিল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তিনি ছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী এবং সচেতন ছাত্র ও কৃষক আন্দোলনের কর্মী। এ রকম একজন কর্মী যখন নিশ্চিত জানেন মিছিলে গেলে তার মৃত্যু হতে পারে, তাকে গুলি করা হতে পারে, তার পরও তিনি মিছিলে গেছেন এবং মিছিলের অগ্রভাগে থেকেছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মৃত্যু নিঃসন্দেহে অন্য যেকোনো মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি ভারী এবং গভীর ব্যঞ্জনাময়। 

এই দেশে যারা রাজনীতি করেছেন তাদের মধ্যে খুব কম লোকই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের মধ্যে শহিদ আসাদ অতুলনীয়। তার মৃত্যুর পর রাজপথে একটি স্লোগান ওঠে ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। সেই সময় জনগণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তরুণরা। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আসাদুজ্জামান জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তাই মিছিল ও স্লোগানে সেই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তাকে স্মরণ করা হয়েছে। এভাবে শহিদ আসাদ বাংলাদেশময় একটি নাম হয়ে উঠেছিলেন। যে নামের মৃত্যু নেই, শেষ নেই, শহিদ হয়েও তিনি অমর। 

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

অনুলিখন : বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫