
নতুন বছর এসেছে রাজনৈতিক বিতর্ক আর অর্থনৈতিক চাপ মাথায় নিয়ে। রাজনৈতিক বিতর্ক হচ্ছে গত বছরের অভ্যুত্থানের ঘোষণা তৈরি, সংবিধান, নির্বাচন না সংস্কার এবং বিগত সরকারের বিচার নিয়ে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণ দেখছে দ্রব্যমূল্য কমছে না, কৃষক দেখছে ফসলের দাম পাচ্ছে না, শ্রমিকের মজুরি আর জীবনের ব্যয়ের মধ্যে ফারাক কমছে না। এসবের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হলো ভ্যাটের আওতা এবং পরিমাণ দুটোই বাড়বে। কপালে দুশ্চিন্তার চাপ আর মনে বিরক্তি নিয়েই যেন শুরু হলো ২০২৫।
বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মতো ছয়টি পর্বে ২০২৪ সালকে ভাগ করা যায়। জানুয়ারির অবিশ্বাস্য আমি-ডামির নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল পর্যালোচনা, আর এই নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গেয়েছে আওয়ামী লীগ। মার্চ-এপ্রিল ছিল হতাশার কাল। জনগণ ভাবতে শুরু করেছিল যে, কোনোভাবেই প্রশাসন, পুলিশ আর দলীয় মাস্তানদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না আর সরকার ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগ করতেই থাকবে যতদিন তারা চায়। মে-জুন ছিল অবাধ দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধতার কাল। দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, লুটপাট লাগাম ছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিওনের হাতে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল। জুলাই আগস্ট ছিল স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির কাল। সাঈদের মৃত্যু যেন বাঁধ ভেঙে দিল সাহসের। কারফিউ উপেক্ষা করা, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে মরতে মরতে মানুষের মরার ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়ে গেল। নতুন ইতিহাস রচিত হলো, বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তকমা পাওয়া প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ ও পলায়নের নতুন নজির স্থাপন করলেন। জনগণের ক্রোধের আগুনে পুড়ল সরকারি স্থাপনা, লণ্ডভণ্ড গণভবন, পুড়ল ৩২ নম্বর, ভাঙল মুজিবের ভাস্কর্য। পালিয়ে গেল সব মন্ত্রী, এমপি এমনকি বাইতুল মোকাররমের খতিব পর্যন্ত। এ এক অবিশ্বাস্য পতন ও পলায়ন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নতুনভাবে দেশ গড়ার স্বপ্নের পাশাপাশি একদিকে অস্থিরতা, উত্তেজনা, দখল আর অন্যদিকে অতীত সরকারের দুর্নীতির নতুন নতুন দৃষ্টান্ত উন্মোচন করার কাল। নভেম্বর-ডিসেম্বরে মানুষ আবার সংশয়ে পড়ে গেল। নানা বিতর্ক আমদানি হতে থাকল, ভারতের নানা পদক্ষেপ আর দেশের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা লক্ষ করে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল, আসলে হচ্ছেটা কী?
বছরের শেষে ঘোষণা হয়েছিল, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণা হবে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে। শুরু হলো উত্তেজনা, কী লেখা হবে, কে লিখবে এবং কখন লিখবে এই ঘোষণা? অভ্যুত্থানের আগের দাবি কী ছিল, আর পরে কী কী দাবি উত্থাপিত হচ্ছে, তার মধ্যে সমন্বয় করবে কারা? ফ্যাসিস্ট শাসন উৎখাতের সংগ্রামে যত ঐক্য ছিল, পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালিত হবে কোন পথে, তা নিয়ে বিরোধও ততটাই যেন বেশি। সংবিধান নতুন না সংশোধন হবে, সেই বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্কার নাকি সংস্কার করে নির্বাচন, ৫২ বছর রাজনৈতিক দলগুলো কী করেছে, এই বিতর্ক তোলার চেষ্টা রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি করেছে। আবার সংবিধান ছুড়ে ফেলা কিংবা মুজিববাদী সংবিধান কবরস্থ করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অভ্যুত্থানের ঘোষণা প্রকাশ করা হবে বলে জানানোর পর রাজনৈতিক মহলে আলোচনা এখন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।
রাজনৈতিক আলোচনা, বিতর্ক, উত্তেজনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনের সংকটগুলো তীব্র হচ্ছে। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগাম ধরতে পারছে না, ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে, শীতকালীন সবজি বাজারে উঠতে না উঠতে কৃষক সেই পুরোনো চক্রে আটকে গেছে। সবজি উৎপাদকরা দাম পাচ্ছেন না। রংপুরে ও গাইবান্ধায় ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে দুই টাকা কেজি, কৃষকের মাথায় হাত। সার নিয়ে সংকটের আশঙ্কা, মূল্যবৃদ্ধি, বীজ-কীটনাশকের দাম এবং মান নিয়ে সেই পুরোনো খেলা কৃষকের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি আর চাকরি নিয়ে ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। মানুষ ভাবছে একদিকে সংবিধান কবরস্থ করার ঘোষণা, অন্যদিকে জনগণের সম্পদ পকেটস্থ করার কাজ চলছে। এর সঙ্গে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সংগতি কোথায়? শ্রমিকের বাড়বে না আয়, কৃষক পাবে না ফসলের ন্যায্য দাম, সেই পুরোনো বৃত্ত কি ভাঙবে না এবারও।
অন্যদিকে দেশের রপ্তানি বেড়েছে বেশ ভালো পরিমাণেই। যদিও বেতন না পাওয়া, চাকরি হারানো শ্রমিকদের আন্দোলনে আশুলিয়া, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রম অসন্তোষ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। গার্মেন্টস ধ্বংস হয়ে যাবে এ রকম প্রচারণার মধ্যেই দেখা গেল, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। একক মাসের হিসাবে ডিসেম্বরে রপ্তানির হারটা আরো বেশি। এই মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
ইপিবির হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, একক মাস ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৬৩ কোটি ডলারের। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট রপ্তানির পরিমাণ দুই হাজার ৪৫৩ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বা প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১৭৪ কোটি ডলার।
তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ টানা পাঁচ মাসের শ্রম অসন্তোষের মধ্যেও পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২২৩ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার কোটি টাকার মতো।
দেশের রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স এসেছে সর্বোচ্চ পরিমাণে। ডিসেম্বর মাসে ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরা। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণে। ২৬.৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। বছরের হিসেবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২২ সালে, প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। দেশের প্রতি প্রবাসীদের দায়িত্বের আবারও প্রমাণ পাওয়া গেল। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ায় বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়ে এখন ২১.৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
অর্থনীতির এসব ইতিবাচক খবরের মধ্যেই আবার জানা গেল ভ্যাটের আওতা বাড়ছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে যোগ হচ্ছে পরোক্ষ করের বাড়তি বোঝা। বাড়তি করের তালিকায় রয়েছে ওষুধ, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, জুস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এলপিজি গ্যাস, বিমানের টিকিটসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবা। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জনজীবন বিপর্যস্ত। এ সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বর্তমানে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি; আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ, যা পাশের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এরপর নতুন করে ৪৩ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। জনগণ চায় দুর্নীতি, কর ফাঁকি বন্ধ করা হোক, কিন্তু ভ্যাটের আওতা বাড়লে ব্যয়ের বোঝা তো সাধারণ মানুষের কাঁধেই চাপবে।
সাধারণ মানুষের চাওয়া খুব বেশি নয়, তারা সাধারণভাবে বাঁচতে চায়। তারা যখন পত্রিকায় পড়ে সারা দুনিয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম ২৪ শতাংশ কমছে আর বাংলাদেশে ৮ শতাংশ বাড়ছে, দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে ফসলের দাম কম আর শহরে অস্বাভাবিক বেশি, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার কী করে? সরকার কি ব্যবসায়ীর না জনগণের পক্ষে কাজ করছে? বিগত বছরগুলোতে যে ব্যবস্থা ছিল তাই যদি বহাল থাকে তবে বদল হলো কি শুধু শাসকের? নতুন বছরে এই বিতর্ক যেন জমে উঠছে ভালোভাবেই।