Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

‘সঠিক’ ইতিহাসের সন্ধানে

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৩

‘সঠিক’ ইতিহাসের সন্ধানে

আজকাল স্মৃতি আর ইতিহাস নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমাদের এই ইতিহাস নিয়ে সংকট কাটবে না বোধহয়। এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করে। আমরা খোঁজ করি ‘সঠিক’ ইতিহাস, যদিও সেটার কী মানে আমরা সঠিকভাবে বলতে পারি না। ধরে নেওয়া যেতে পারে, যেটা আমাদের কাছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সেটাই ‘সঠিক’। তার সঙ্গে বাস্তবের ঘটনার মিল থাকতে পারে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি থাকে গ্রহণযোগ্যতা। যে ইতিহাস শুধু জানায় তার প্রতি আমাদের আগ্রহ কম। কিন্তু যে ইতিহাস বলে আমরা ‘সঠিক’ বলছি, ওটাই ইতিহাস। মনে হয় না এই প্রবাহ থামবে। আমরা ভুলে যাই যে কোনো বড় ঘটনার ছোট ছোট প্রতিধ্বনি থাকে। আমরা দুটোরই অংশ অর্থাৎ ইতিহাস সমুদ্রের মতো, আমরা পানিতে নামলে তার অংশ হই, কোথায় শুরু কি শেষ, সব সময় বলা যায় না।

দুই.

মনে আছে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারির কথা। সবাই জানে ১০ তারিখে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফেরেন। বাংলাদেশ স্বাধীন বা পাকিস্তান মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। কিন্তু এরপর ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল না। দেশে অনেক কাঠামোই হয় বিলুপ্ত অথবা আইন প্রয়োগ করার মতো অবস্থা ছিল না সরকারের। কে ক্ষমতায় রয়েছে তা ছিল কিছুটা ধূসর বিষয়, কারণ সরকার তখনো তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর মধ্যে ঘটছিল প্রতিশোধ নিতে হত্যাকাণ্ড থেকে লুটপাটের ঘটনা। ভালো মানুষ সব সময় একটু অসহায় থাকে আর কিছু মানুষ তার সুযোগ নেয়। ঢাকায় অবস্থা তাই। অনিশ্চয়তার সূর্য বেশ উজ্জ্বল হয়েই জ্বলছিল। সেটা যেমন রাষ্ট্রকাঠামোতে, সেটা তেমনি আমাদের পাড়ার উচ্চ-মধ্যবিত্ত গলিতে।

তিন.

যদিও আমাদের পাড়ায় বেশ কয়েক ঘর মুক্তিযোদ্ধার বাস, কিন্তু গোটা যুদ্ধের বছর আমাদের গায়ে আঁচড় লাগেনি। আমাদের বাড়িতে ও অন্য বাড়িতেও অনেক হিন্দু মানুষ আশ্রয় নেয়। কিন্তু কেউ তাদের ধরিয়ে দেয়নি। পুরা বিপদহীন একাত্তর পার করেছি আমরা। কিন্তু যুদ্ধের পর অবস্থা পাল্টাল। কিছু বিপথগামী মানুষ আসা-যাওয়া শুরু করল, দু-একটা বাড়িতে ‘ডাকাতি’ হলো। একজন সাধারণ পানির মিস্ত্রিকে ‘রাজাকার’ বলে শনাক্ত করে গুলি করে মারল পাড়ার মাঝখানে। হঠাৎ করে সবার মনে ভয় জন্মাল, অথচ পাকিস্তান-শত্রু তখন পরাস্ত।

চার.

আমাদের পাড়ায় একটি পরিবার ছিল ‘আহমেদ’ সায়েবরা। পরিবারে ৫ নারী, বড় মেয়ে বিলকিস আপা আমার স্কুলের সিনিয়র, মেট্রিক পাস করেছেন খুব ভালো রেজাল্ট করে। তার বাবা অবসর নেওয়া সরকারি কর্মচারী, বাড়ি করে ঢাকার পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। সবার সঙ্গে সদ্ভাব। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের একটি পার্থক্য ছিল- তারা অবাঙালি, উর্দুভাষী। একদিন তাদের বাড়িতে এসে ছয়-সাত তরুণ ঘরে ঢুকে সব লুট করল। পাড়ার মানুষের বলার কিছু নেই, অস্ত্রের সামনে মানুষ নীরব। আহমেদ পরিবার দেওয়াল টপকে আশ্রয় নিল পাশের বাড়িতে। লুটেরারা চলে গেলে তারা বাড়ি ফিরল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই লুটেরা পার্টি আবার ফেরত এলো। কারো বুঝতে বাকি রইল না কেন ফিরে এসেছে। বিলকিস আপারা আবার দেওয়াল টপকে আশ্রয় নিলেন কোনো বাড়িতে। সেই মানুষগুলো চিৎকার করে শাসিয়ে একসময় চলে গেল। বলল, আবার তারা আসবে। 

পাঁচ.

আশ্রয়দানকারীরা শেষ পর্যন্ত আর নিরাপদ ভাবতে পারেননি নিজেদের, আমাদের বাবা-মায়ের কাছে এসে আহমেদ সায়েবদের আশ্রয় দিতে বলেন। তারা দেন। সেই রাতটা আমার জীবনের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে সবচেয়ে ভয়াবহ কাল। আমরা জানতাম তারা আসবে, জানতাম আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে অসহায় দুই নলা শিকারের বন্দুক দিয়ে, যার মানে নিশ্চিত মৃত্যু সবার জন্য। কিন্তু আমাদের করার কিছু ছিল না। আমরা কি স্বেচ্ছায় তাদের আশ্রয় দিতাম? না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমরা তাই করতে বাধ্য হয়েছিলাম। একেবারে অসহায় একটি পরিবারকে আশ্রয় দেই মৃত্যু হতে পারে জেনেও। এটাই ইতিহাস, এটা সাধারণ মানুষ, পাড়া, সমাজ, সরকার, রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক প্রবল। নির্ধারণ করে কে কী করবে, করবে না। 

ছয়.

সেই রাতে সেই তরুণরা এসেছিল রাত ২টার সময়, গাড়িটা রাখে আমাদের গেটের সামনে। আমরা দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে তাদের দেখতে থাকি, তারা অপেক্ষা করে আধঘণ্টার মতো, তারপর চলে যায়, কেন জানি না। সকালবেলা আমরা আহমেদ সায়েবের পরিবারকে গাড়িতে লুকিয়ে ইস্পাহানি কলোনিতে অনেক নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেই। বহু পরে জানতে পারি সেই দল ভেবেছিল আমাদের কাছে নিশ্চয় অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে, না হয় অতো সাহস হলো কী করে আশ্রয় দেওয়ার। আসলে আমরা সাহসী ছিলাম না, আমরা ইতিহাসের দাস ছিলাম। তাদের মতো আহমেদ সাহেবদের মতো, পাড়ার সবার মতো। হয়তো দেশের সবার মতো।

সাত.

এই যে ঘটনা বললাম এর মধ্যে কোনটা ইতিহাস, কোনটা ‘সঠিক’, কোনটা স্থান পাবে স্মৃতিতে? আমি মনে করি সবটাই, সবাই, প্রতিটি ঘটনাই। এর মধ্যে সঠিক আর বেঠিক ইতিহাস বলে কিছু নাই, সবটাই ইতিহাসের অংশ। আমরা যেটা করি নিজেদের মতো করে অতীত সাজাই, আর যেটুকু আমাদের কাজে লাগে তাকে ব্যবহার করি, বাকিটা ফেলে দেই। আর বলি আমাদেরটাই সঠিক বয়ান, বাকি সব মিথ্যা। এটা কেবল একাত্তরের ক্ষেত্রে নয়, সকল ক্ষেত্রে। এমনকি আজকেও তাই হচ্ছে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। আগামী দিনেও তাই হবে।

আট. 

আমাদের দেশে ইতিহাস রাজনীতির অংশ, আমাদের স্মৃতিকেও এই রাজনৈতিক নির্মাণের কাজে লাগাই। ফলে আমাদের ঠিক করে জানাও হয় না। আমরা সুবিধার লেবাস পরিয়ে ভালো-মন্দ ঠিক করে ফেলি। ফলে আমাদের জানাটা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছি না। বলছি অতীতের, বর্তমানের ও আগামীর পাপ আর পুণ্যের আমরা সমান অংশীদার।

নয়.

এই ঘটনা সেখানে শেষ হয়নি, তার নিজস্ব গতিধারায় এগিয়েছে। তবে এটাও জানি, ওই ঘটনার এক মাস পর বন্ধুদের এক আড্ডায় গুলি ভরা পিস্তলকে খালি পিস্তল ভেবে খেলতে খেলতে ওই রাতের অভিযানকারী দলের নেতা দুর্ঘটনাবশত মাথায় গুলি খেয়ে মারা যায়। সেটাও ইতিহাসের অংশ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫