Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

নারীর পোশাক রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে না উঠুক

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৫

নারীর পোশাক রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে না উঠুক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর পতিত স্বৈরাচার ও তাদের মদতদানকারী মিত্ররা এমন একটা প্রপাগান্ডার মেশিন খুলেছে, যেখানে তারা এটা দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। এটা প্রমাণের জন্য তারা ক্রমাগত নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে। সেখানে নারীর স্বাধীন মত প্রকাশ ও চলাচলে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে নারীর পোশাক রাজনীতি, যা বিশ্বজুড়ে একটি স্পর্শকাতর ইস্যু- এই বিষয়টি বারবার সামনে এসে পড়ছে। বাংলাদেশে নারীদের পোশাক নিয়ে আলোচনা প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এটি শুধু নারীদের পোশাকের স্বাধীনতাকেই প্রভাবিত করে না, বরং সমাজের লিঙ্গবৈষম্য ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়েও এক গভীর আলোকপাত করে। সাম্প্রতিককালে বিষয়টি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, প্রকারান্তরে আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্রের অনুষঙ্গ হিসেবেও দেখা দিয়েছে। 

সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলের টকশো অনুষ্ঠানে একজন নারী আলোচককে   নেকাব খুলতে বলা হয়েছে এমন একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আমাদের দেশে নারীর পোশাক নিয়ে মোরাল পুলিশিং একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নারীর পোশাক নিয়ে এ সমাজ এতটাই অসহিষ্ণু যে, সবাই তার মতবাদ অনুযায়ী নারীকে দেখতে চায়। এক পক্ষ যেন আরেক পক্ষকে সহ্যই করতে পারে না। জুলাই-পরবর্তী সময়ে নারীর পোশাক নিয়ে বড় ধাক্কা আসে কক্সবাজারের একটি ঘটনায়। যেখানে ফারুকুল ইসলাম নামের এক যুবকের নেতৃত্বে একদল লোক সমুদ্রসৈকতে নারীদের আক্রমণ ও অপমান করে, তাদের পোশাককে ‘অশালীন’ বলে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

নারীর পোশাক কী হবে, তা কে নির্ধারণ করবে? উদার গণতন্ত্র বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নারীর। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বের বহু সমাজে ও শাসন প্রণালিতে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য এতই প্রবল যে, নারীরা নয়, তাদের পরিবার বা সমাজ, প্রায়ই রাষ্ট্রও তাদের হয়ে এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে। আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ নারীদের পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ স্থির করতে ব্যস্ত। সেই উদ্যোগ সচরাচর নারীর শরীর আবৃত রাখার উদ্যোগ। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, নারীশরীর আবৃত রাখা চলবে না, এমন বিধানও কিন্তু প্রকারান্তরে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। মেয়েরা কী পরবে, সেটা তারাই ঠিক করবে। এর ওপর নিশ্চয়ই কোনো কথা চলতে পারে না। তবে এ দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েরা যে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয় সেখানেও একশ্রেণির মানুষ তাদের পোশাককে এ জন্য দায়ী করতে শুরু করে। মেয়েদের পোশাক নিজস্ব রুচি-পছন্দের বাইরেও অন্যের রুচির দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়।

নারীর কাছে ‘পররুচি’র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরে, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, আজও তা সুকৌশলে পুরুষশাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। ধর্ম, বর্ণ ও শিষ্টাচার বিধান দিয়ে থাকে, কোন পোশাকে একটি নারী সমাজের লোকচক্ষুর সামনে এসে দাঁড়ালে তা হবে শোভন। এটি পোশাকের বাহুল্য, দৈর্ঘ্য বা স্বল্পতার প্রশ্ন নয়, যদিও দৈনন্দিন তর্কাতর্কি বিষয়টিকে ক্রমাগত সেই দিকেই ঠেলতে থাকে। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে স্থান ও কাল বিশেষে সামাজিক নিয়মাবলি শালীনতার সীমানা বারবার নির্ধারণ করে দেয় এবং মেয়েদের সেই নিয়ম মেনে নিয়ে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হয়। নারী কী ধরনের পোশাক পরবে-এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে করপোরেট ওয়ার্ল্ডও ঠিক করে দেয়। ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নির্ণয় করে নারী কতটা কাপড় খুলবে, বা কতটা ঢাকবে। গত এক দশকে বাংলাদেশের নারীর পোশাকে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, যা যতটা না নারীর নিজের প্রয়োজনে তার চেয়ে অনেক বেশি অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমল দিতে গিয়ে। নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র যত বিস্তৃত হচ্ছে, নারীকে তার প্রয়োজনে যত বাইরে যেতে হচ্ছে, তত সে পোশাকের রাজনীতিতে আরো শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ছে। নারীর পোশাকের প্রতি এই কঠোরতা মধ্যবিত্ত সমাজে যতটা জোরালো, নিম্নবিত্তের ভেতরে ততটা না, যা আমরা পোশাক শ্রমিক ও অন্যান্য নারী শ্রমিকের পোশাকের দিকে নজর দিলে দেখতে পাই। তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের ক্ষেত্রে পোশাকের এই বাধ্যবাধকতা কিসের? কারণ কি একটাই যে, এরা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছে, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাপিয়ে যাচ্ছে! সে কারণেই পুরুষ তাকে তার কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরোক্ষভাবে হেনস্তা করছে, কখনো তাদের পছন্দমতো পোশাক পরায় বা কখনো না পরায়! 

একুশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বে যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে, দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদী সরকারগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক জোরজবরদস্তির একটা রূপ সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। সে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে হোক বা উন্নয়শীল বা তৃতীয় বিশ্বে। প্রথম বিশ্বে নারীর হিজাব পরায় বাধা দেওয়া বা মুসলিমপ্রধান দেশে হিজাবে ঢাকতে বাধ্য করার প্রবণতার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়  মেলে। তবে পুরুষের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যতটা না ধর্মীয় প্রভাব আছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক  প্রভাব।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাসিনা শাহীর পতনের পর। ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের ধারণাটি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। কোনো বৈষম্য ভেদাভেদ নয়, সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ গড়ার স্পিরিট ছিল এই আন্দোলনে। যেখানে আমরা সব শ্রেণি-পেশা এবং মতামতের মানুষকে এক হতে দেখেছি। সবার বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পোশাকের স্বাধীনতা, সংস্কৃতিসহ সবকিছুই থাকবে মিলেমিশে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, নানাভাবে নানা গোষ্ঠী, ব্যক্তি এই ‘ইনক্লুসিভ’ ধারণা থেকে বের হয়ে আসছেন। যদিও তারা আন্দোলনের সময় বা তার আগে এই ধারণার পক্ষেই কথা বলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা তাদের নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে এবং চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন অন্যের ওপরে, যা অনেকটাই ১৫ বছর ধরে চলে আসা আওয়ামী লীগ সরকারের ধারণার মতো। সর্বজন ও সর্বমতের সহাবস্থান যদি না থাকে, তাহলে একটি অবাধ গণতান্ত্রিক সমাজ গড়া কীভাবে সম্ভব হবে! আর যেখানে যত ভেদাভেদ, সেখানে শত্রুর সফলতার সম্ভাবনা তত বেশি- এটা তো আমাদের অজানা নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫