-6207784b75a09-679c4cf4c13bf.png)
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব সরকারের সামনে রাখার সংকল্প নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে চারটি কমিশন তাদের প্রস্তাবনাগুলো হস্তান্তর করেছে। জনগণের প্রত্যাশা ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো এসেছে বলেই প্রস্তাবকরা মত প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে গঠিত কমিশনের প্রতিটাই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নের দায় রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের, তবু বাস্তবতা এই যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য অস্থির, অন্য দিকে প্রশাসনসহ সব সেক্টর রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত। এই রাজনীতি ও প্রশাসন দিয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা বিবেচনার দাবি রাখে।
ড. আলী রীয়াজ গত ১৫ জানুয়ারি তার প্রস্তাবনাগুলো হস্তান্তর করেছেন। শুরু থেকেই সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় অনেকেই নতুন করে সংবিধান লেখার দাবি উপস্থাপন করেছিলেন। অনেকে আবার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল স্তম্ভ হিসেবে ’৭২-এর সংবিধানে স্থান পাওয়া গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন। দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করে দ্বিতীয় স্বাধীনতাপ্রাপ্তি হয়েছে, বিষয়টি সংবিধানে সবিস্তারে স্থান দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। সুপারিশমালা জনসমক্ষে আসবার পর দেখা যায় প্রাগুক্ত চারটি মূলনীতির মধ্যে তিনটির পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারসহ বহুত্ববাদীকে মূলনীতি করার সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্যের আলোকে’ এই মূলনীতি। সমস্যাটা এখানেই। কমিশনের প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে প্রথম স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে কি না, ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আমরা বোধ করি ভুলতে বসেছি সংবিধান সংস্কার মানে নতুন সংবিধান লেখা নয়। বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের বিষয়গুলোতে পরিবর্তন এনে তাকে যুগোপযোগী করা। এতদিন দেশের মানুষ বাহাত্তরের সংবিধানকে আদর্শ সংবিধান মনে করত। বেশির ভাগ মানুষ আজও করে। ফলে সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের সুপারিশকে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মমূলে আঘাত বলেই মনে করছেন।
সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, দেশে যে বৈরী রাজনীতির সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে আগামী দিনে আরো অনেক এমন স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যাবে। সবই যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে হয় তাহলে এর আগের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অপরাধ কোথায়? সবাই সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে, কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা থেকে অগ্রগতি যে অনেক পিছিয়ে পড়ছে প্রতিদিন, কেউ সেটা বুঝতে চাইছে না।
সংবিধান সংস্কারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্ষমতার ব্যালেন্স তৈরি, যাতে কেউ একক ক্ষমতাবলে স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ না পায়। রাজনৈতিক দল থেকে সরকার পরিচালনা একক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করলে স্বাভাবিক নিয়মেই সরকার স্বৈরাচার হয়ে পড়ে। দেশে অনেক দল আছে, যারা মনোনয়ন দিয়ে কমিটি গঠন করে। দেশের গণতন্ত্র এমন রাজনৈতিক দলের হাতে কতটা নিরাপদ তা বিবেচনা করেই সংস্কারে ব্রতী হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, যে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য দেশের মানুষ সংগ্রাম করল, সেই গণতন্ত্র এক সংশোধনীতেই বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল বাকশাল তৈরির জন্য। ক্ষমতায় থেকে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না তা ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকেই জনগণ দেখেছে। বিকল্প হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করা হলেও তা বাতিল হয়েছে। জাতীয়তাবাদ আর নাগরিকত্বের দড়ি টানাটানিতেই অর্ধশত বছর পার হয়ে গেছে। একজন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের মাথায় বিসমিল্লাহ বসিয়ে দিয়েছেন। আর একজন রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। গত ৫৪ বছরে সমাজতন্ত্রের কথা কারো মনে পড়েছে, এমন কোনো সময় মনেই হয়নি। মসনদ দখলে রাখতে যখন যে যা মনে করেছে সেই মতো সংবিধানকে ব্যবহার করতে গিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছে। সংবিধান সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল এই বিষয়গুলো ফেরত আনা। কিন্তু প্রস্তাবনায় তার কণামাত্র দৃশ্যমান হলো না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈর সরকারের পতন ঘটেছে। আগামী দিনে যাতে আর কোনোভাবে স্বৈর সরকারের শাসন জনগণকে ভোগ করতে না হয় তার ব্যবস্থা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে পারলে জনগণ মুক্তি পেতে পারে। সবাই জানে রাষ্ট্রপতি দলীয় পদত্যাগ করে দলীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকেন। দলীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় টার্মে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব নয় বিধায় তিনি দলের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ অবস্থার মুক্তি প্রয়োজন। তা করা গেলেই ক্ষমতার ব্যালেন্স পাওয়া সম্ভব। তাহলেই তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় যেকোনো সংকটে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে পারবেন।
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোথাও গণতন্ত্র চর্চা দেখা যায় না। জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সারা দেশের সর্বত্র নেতারা বিশ্বাস করেন তাদের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়বে। সে কারণে একবার পদ পেয়ে আর ছাড়তে চান না। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি রাজার ছেলে রাজা হবে, জমিদারের ছেলে জমিদার হবে, বীরের ছেলে বীর হবে, গুরুর ছেলে গুরু হবে, তার ধারাবাহিকতা আজও চলমান। এখন নেতার ছেলে নেতা হয় আর সংসদ সদস্যের ছেলে সংসদ সদস্য হয়। অতীত অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতায় পীরবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটেছে, নির্বাচনের নামে সন্ত্রাস ও ভোট ডাকাতির মতো নোংরা বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। প্রজাতন্ত্রের মালিকরা আজ প্রজা হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি শুধু জনতান্ত্রিক শব্দটির মধ্য দিয়ে আসবে কি না সন্দেহ।
দেশের সাধারণ মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার তা নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষাকে অধিকারভুক্ত করতে হবে। বিগত সরকার শিক্ষা আইন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও গত এক যুগে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের সরকারগুলোর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা ছিল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারগুলো লাঠিভিত্তিক সমাজ গঠন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখায় নিবেদিত ছিল। সে কারণে শিক্ষাকে পণ্য করা হয়েছে, মানহীন করা হয়েছে, সাধারণ শিক্ষাকে গিনিপিগ করা হয়েছে, সনদ ক্রয়ের কারখানা তৈরি করা হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিত্তবানসহ দায়িত্বপ্রাপ্তদের চরমভাবে বিদেশমুখিতার কারণে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলা যায়নি। আজকের চিকিৎসাব্যবস্থা পুরোটাই ব্যাবসায়িক মানসিকতার মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে। রোগীদের চিকিৎসক দেখেন না, বরং তারা চিকিৎসককে দেখেন। চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে ব্যবস্থাপত্র দেন। প্রয়োজনের থেকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের বিশাল ব্যবস্থাপত্র রোগীর হাতে ধরিয়ে দেন। মানহীন ওষুধে বাজার সয়লাব, সঙ্গে দামের ঊর্ধ্বগতির প্রতিযোগিতা।
অন্য মৌলিক অধিকার বাসস্থানের নামে যে হরিলুট হলো তা সবার জানা। দেশের জনঘনত্ব বিবেচনা করে জমি রক্ষায় বহুতল ভবন নির্মাণ কতটা জরুরি বিষয় ছিল তা বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়নি কখনো। সিন্ডিকেট বাণিজ্যের ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করে জনগণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যকে নাগালের বাইরে রাখার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা। দেশের খাসজমি যতটা না ভূমিহীন মানুষের ভাগ্যে জুটছে তার কয়েক শতগুণ ক্ষমতাবানরা নিজের করে নিয়েছেন। সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন ছিল মানুষের এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্নে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেই সংস্কারের ক্যানভাস বিশাল। সংস্কারের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে কে? দেশের রাজনীতি ও প্রশাসন কি সংস্কার বাস্তবায়নে দায়িত্ব নেবে? সবাই তো ক্ষমতার ভাগিদার হওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে। যত দিন যাচ্ছে ততই অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। দেশের কালাকানুনগুলো যারা ক্ষমতার বাইরে থাকলে বাতিলের দাবি করে আর ক্ষমতায় গিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, তারা যে ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার প্রস্তাব মেনে চলবে না, সেই সন্দেহ অমূলক নয়।
নিজেকে সিঙ্গাপুরের নাগরিক দাবি করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ চুক্তির আলোকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা সুরক্ষা দাবি করেছে একজন পাচারকারী। একজন বিদেশি নাগরিক কীভাবে বিশাল অঙ্কের ঋণ পেল, কাদের সহযোগিতায় পেল তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। আগামী দিনে যাতে এমন কোনো পরিস্থিতি না হয়, দ্বৈত নাগরিকরা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হতে না পারে, তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি। সংবিধান নতুন করে লেখা নয়, বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সংবিধান থেকে একাত্তরের প্রতিশ্রুত মৌলিক নীতিগুলো বাতিল করবার প্রস্তাব কাম্য নয়।