Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বিশ্ববিদ্যালয়ে দখলদারির রাজনীতি শেষ হবে

Icon

শামীমা সুলতানা

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২৩

বিশ্ববিদ্যালয়ে দখলদারির রাজনীতি শেষ হবে

২ আগস্ট ২০২৪, অফিস কক্ষ থেকে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেন শামীমা সুলতানা।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের শুরু কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি ছিল শিক্ষার্থীদের একটি ন্যায্য আন্দোলন, যেখানে বলা হচ্ছিল মেধাকে যেন প্রাধান্য দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তো সঠিক কোনো তালিকা নেই, সে সুযোগটাই নিয়েছে গত স্বৈরাচারী সরকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে তারা নিজেদের মতো তালিকা তৈরি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে, নিজেদের লোকদের বিভিন্ন জায়গায় সুবিধামতো বসিয়েছে। বিষয়টি মেধাবীরা অনেক দিন ধরেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু তারা কিছু করে উঠতে পারছিল না। ২০২৪-এর জুলাই থেকে তারা নতুন করে জেগে ওঠে। 

কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি নিয়েই তারা সামনের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময় আমরা দেখলাম নানাভাবে এখানে উসকানি দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী সবার অধিকার নিয়ে কথা বলবেন- এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত ছাত্রদের বিপক্ষে গেলেন। এবং তার চারপাশের যে মানুষ, যারা নানা পদে ছিলেন তারাও একই সুরে কথা বললেন। ওবায়দুল কাদের বলেই বসলেন, ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত’। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি, তাদের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, একটি নির্দিষ্ট দলকে- পেটোয়া বাহিনীই বলব, তাদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যেই কোটা বহাল ছিল। যখন তাদের স্বার্থে আঘাত লাগল, নির্যাতনের মাধ্যমে তারা প্রতিহত করার চেষ্টা করতে থাকল। জাহাঙ্গীরনগরের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ১৫ জুলাই থেকে এখানে নির্যাতনটা শুরু হলো, এটা ভয়াবহ রূপ নিলো শিক্ষার্থীরা যখন ভিসির বাসভবনে গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা সে জায়গাটিকে নিরাপদ মনে করার কথা। কিন্তু নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নেওয়ার পর তাদের ওপর সম্মিলিতভাবে হামলা চালানো হলো। ১৫ তারিখে ঘটে যাওয়া হামলা ও নির্যাতনের ঘটনার পরদিন থেকে আমরা কিছুসংখ্যক শিক্ষক রাস্তায় নেমে আসি, মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকের কাছে গিয়ে জবাব চাই। দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা আমাদের সন্তুষ্ট করার মতো কোনো উত্তর দিতে পারেননি, দায়সারাগোছের একটা উত্তর দিয়ে তড়িঘড়ি করে হল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে। শিক্ষার্থীরা হল ছাড়েনি, তারা জানত কিভাবে ন্যায্য আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করা হয় নানা পেটোয়া বাহিনী দিয়ে।

শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান, তাদের জন্যই আমরা শিক্ষক। ‘শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর’, সে জায়গা থেকে মনে হলো এবার রাস্তায় নেমে আসার সময় হয়েছে। আমরা যদি আদর্শ জাতি গড়তে চাই- যারা আমাদের ভবিষ্যৎ, তাদের জীবনের নিরাপত্তাও কিন্তু আমাদের দিতে হবে। ১৭ তারিখ আমরা সাত-আটজন শিক্ষক আবার বিচারের দাবিতে ভিসির বাসভবনে গেলাম কথা বলতে, তিনি কথা বলেননি, এমনকি আমাদের ভেতরে পর্যন্ত ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটে তালা মেরে তারা ভেতরে বসেছিলেন। এদিকে দেখতে পেলাম পুলিশ এনে ক্যাম্পাস ভরে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে হল ছাড়তে। শিক্ষার্থীরা যে জায়গাটিকে নিরাপদ মনে করে, সেখানে গিয়েও কেন নিরাপত্তা পেল না, বিচার পেলো না, এর বিচারের দাবিতে আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনড় ছিলাম। শিক্ষার্থীরা ও পুলিশ প্রায় মুখোমুখি হয়ে যায় এক পর্যায়ে। ঘড়িতে বিকেল ৪টা বাজলে পুলিশ অ্যাকশনে চলে যায়। তখন আমি আমার বিভাগ গোপনে খুলে দিয়েছিলাম, যেন শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নিতে পারে। আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিভাগের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিই। অন্যদিকে যে শিক্ষার্থীরা আটকা পড়েছিল তাদের উদ্ধার করা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের হলে পৌঁছে দিতে থাকলাম, হলে হলে গিয়ে গার্ডদের বলে এলাম, যে শিক্ষার্থীই আসুক না কেন তারা যেন জায়গা দেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একটি অযৌক্তিক মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে মানুষ কোনো আশার বাণী খুঁজে পায়নি, উল্টো তিনি শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করলেন, এবং প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া হলো, শিশুরাও রক্ষা পেল না। এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ২ আগস্ট বিভাগের আমার কক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলি। আমার মনে হয়েছে ‘এই স্বৈরশাসকের ছবি আর এই দেওয়ালে রাখা যায় না, যার হাতে এত রক্তের দাগ লেগে আছে, সেই খুনির ছবি এই দেওয়ালে রাখতে চাই না।’ ছবিটি নামানোর পরদিন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ থেকে আমার বিচার চেয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। সেই বিবৃতিতে আমার বিরুদ্ধে নানা রাগ, উষ্মা প্রকাশ করে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে আমাকে শোকজ করা হয়েছে- যদিও সে চিঠিটি আমার হাতে আসেনি।  

৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার উদ্দেশে লংমার্চ শুরু করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার কলেজ, মডেল কলেজসহ আশপাশের যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রায় সবাই এসেছিল। পুলিশ একটু-একটু পিছিয়ে যায় আর আমরা এগোই, এর মধ্যে হাজার-হাজার শ্রমিক এসে যোগ দেয়। দুপুর ২টায়, লংমার্চ সাভার সিটি সেন্টারের সামনে পৌঁছাল, তখন সমন্বয়করা আমাকে মিছিলের তত্ত্বাবধানে রেখে ওরা সামনে এগিয়ে গেল, আর সাতজন শিক্ষক হাত তুলে পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলেন এটা বলতে যে, ‘আমরা ঢাকায় যেতে চাই’। সমন্বয়করা পেছন থেকে মাইক দিয়ে বলে যাচ্ছিল, আমাদের শিক্ষকরা যাচ্ছেন আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন। কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাতেই পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়া শুরু করল, টিয়ার শেল মিছিল পর্যন্ত চলে আসে। শিক্ষকরা কোনোক্রমে দৌড়ে সরে গেলেন, লংমার্চের জমায়েত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ছোটাছুটি করতে গিয়ে আমি একসময় একা পড়ে যাই। তখন হঠাৎ দেখলাম সিটি সেন্টারের ওপর থেকে গুলি করা হচ্ছে, আমার পাশ দিয়ে গুলি যাচ্ছে, আমি ছোটাছুটি করতে গিয়ে পড়ে যাই এবং প্রচণ্ড ব্যথা পাই, সে অবস্থাতেই মাথা নিচু করে ছিলাম অনেকক্ষণ। তারপর দৌড়ে রাস্তার উঁচু ডিভাইডার পেরিয়ে অন্যপাশে চলে গেলাম। তারপর একজন শিক্ষক ও এক কর্মকর্তা একটি সিএনজিতে করে ভেতরের রাস্তা ধরে আমাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। আমি সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেদিন রক্ষা করেছেন। আমাদের লংমার্চের ওপর যখন টিয়ার শেল ও গুলি চালানো হচ্ছে ততক্ষণে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। সন্ধ্যা ৭টায় আমরা যখন শ্রাবণের জানাজার পড়ছি তখনো সাভার এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছিল। 

শেখ হাসিনা নিজের চেয়ারটাকে ধরে রাখার জন্যে তার দোসরদের নানাভাবে  সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে সিট পেত না। এক ধরনের গণরুম তৈরি হয়েছিল- এটা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দলীয় দোসররা এতটা দাপটের সঙ্গে ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল উপেক্ষিত। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, পনেরো-ষোলো বছর ধরে তারা যে আবর্জনা তৈরি করে গেছে, তা এত দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলা সম্ভব নয়। তবে আমি আশাবাদী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের যে মৌলিক অধিকার তা পাচ্ছে। তাদের বাসস্থান- প্রত্যেক শিক্ষার্থী হলে একটি করে সিট পেয়েছে। তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। একটা সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে ক্যাম্পাসে। 

এটা যদি তারা ধরে রাখতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসবে, তাদের যে ছাত্র সংগঠন, তারা বিগত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে দখলদারির রাজনীতি করতে পারবে না। তবে যারা ভবিষ্যতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবেন, গত সরকারের পরিণতি থেকে তারাও একটা বার্তা পেয়ে গেছেন, ‘যদি স্বৈরতন্ত্র চালানো হয়, জুলুম-নিপীড়ন-দুর্নীতি চালানো হয়, সেটার জবাব কিন্তু জনগণ দিয়ে দেবে’। জনগণই সব শক্তির উৎস- আমরা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে দেখেছি, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে দেখেছি, চব্বিশেও দেখলাম। জনগণ যদি সচেতন থাকে তাহলে কোনো দুঃশাসন জায়গা দখল করতে পারবে না। 

জুলাই আন্দোলনে বৈষম্য দূর করার জন্য সর্বস্তরের মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। সময় এখনো চলে যায়নি। যারা এত বছর বঞ্চিত ছিল প্রত্যেকেই রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেই বঞ্চনা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য। বৈষম্য মুক্তি এত দ্রুত হবে না, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে, ধীরে ধীরে সুফল পাওয়া যাবে, মাত্র চার মাস হলো সরকারের বয়স। তবে সুফলটা বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে নির্বাচিত সরকার এলে। নির্বাচিত সরকার আসার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে যাবেন বলে আশা রাখি। নির্বাচনের পরিবেশ ছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে, লিঙ্গভেদে মানুষের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন বৈষম্য দূর হয়, সেদিকে যেন খেয়াল রাখে অন্তর্বর্তী সরকার। 

লেখক : সভাপতি, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫