বইমেলা: সাংস্কৃতিক বহুমুখিতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি

আদিল ইলাহি
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১৪:১১

বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার জায়গা নয়; এটি একটি সমাজের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। একদিকে এটি সাহিত্য ও শিল্পচর্চার বিকাশ ঘটায়, অন্যদিকে পাঠকদের নতুন নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত করে। যখন বইমেলা কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রচারমাধ্যম হয়ে ওঠে, তখন তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। বইমেলাকে যদি প্রকৃত অর্থে একটি উন্মুক্ত ও বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তবে একে অবশ্যই নিরপেক্ষ রাখা প্রয়োজন, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত চিন্তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।
বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। একুশে বইমেলা যেমন ভাষা আন্দোলনের চেতনার প্রতিফলন ঘটায়, তেমনই পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বইমেলার ওপর রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা মতাদর্শের আধিপত্য লক্ষ করা যায়। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে লেখক ও প্রকাশকদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয় এবং বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বইমেলাকে সত্যিকারের নিরপেক্ষ ও সবার জন্য উন্মুক্ত একটি জ্ঞানচর্চার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সাংস্কৃতিক বহুমুখিতাকে রক্ষা করতে এবং জ্ঞানচর্চাকে স্বাধীন রাখতে বইমেলাকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হবে কীভাবে বইমেলাকে সত্যিকারের নিরপেক্ষ রাখা যায় এবং সাংস্কৃতিক বহুমুখিতাকে বজায় রাখা সম্ভব।
সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ক গুরুত্ব
বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার স্থান নয়; এটি একটি সংস্কৃতির প্রতিচিত্র এবং শিক্ষার উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। একটি সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার যে ভূমিকা, বইমেলা তা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এটি পাঠকদের নতুন নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত করায়, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে এবং সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনসহ বিভিন্ন শাখার জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে। বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, যা সাহিত্যচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
বইমেলা একটি উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার বই স্থান পায়। এখানেই উঠে আসে সমাজের পরিবর্তন, মানুষের চেতনা, ইতিহাসের গৌরবগাথা ও ভবিষ্যতের ভাবনা। বইমেলায় লোকসংস্কৃতি, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গবেষণাধর্মী রচনার সংমিশ্রণ ঘটে, যা জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি নবীন ও প্রবীণ লেখকদের সংলাপের সুযোগ তৈরি হয়, যা নতুন সাহিত্যধারার বিকাশে সহায়ক হয়।
এটি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগতে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। বইমেলায় নতুন নতুন বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে, যা পাঠকদের কৌতূহল বাড়ায় এবং জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করে। সমসাময়িক গবেষণা, নতুন প্রকাশিত বই এবং আন্তর্জাতিক জ্ঞানচর্চার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। শিক্ষার্থীরা এখানে নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি বাড়ায়।
এ ছাড়া বইমেলা শিক্ষার্থীদের ভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষায়িত বই ও গল্পের আয়োজন তাদের শৈশব থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলে। একাডেমিক ও পেশাগত জীবনে উন্নতির জন্য বইমেলায় বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ লেখকদের বই পাওয়া যায়, যা গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অতএব, বইমেলা শুধু একটি বাণিজ্যিক আয়োজন নয়; এটি জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাজনৈতিক প্রভাবের নেতিবাচক প্রভাব
রাজনীতি সমাজ পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও যখন এটি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় প্রবেশ করে, তখন তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, বইমেলার মতো জ্ঞানচর্চার প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্তবুদ্ধি ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বইমেলায় নির্দিষ্ট মতাদর্শের বইকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা সাহিত্য ও জ্ঞানের বহুমুখিতা নষ্ট করে। এতে ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও প্রকাশকদের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে যায় এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে নির্দিষ্ট লেখকদের বই নিষিদ্ধ করা হয় বা তাদের বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ কমে যায়, যা মুক্তচিন্তার পরিপন্থি।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের আধিপত্যের ফলে বইমেলা মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ হয়ে ওঠে।
এতে সাধারণ পাঠক ও প্রকৃত বইপ্রেমীরা বইমেলা থেকে বিরত থাকতে শুরু করে। ফলে বইমেলার জ্ঞানবিনিময় ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বইমেলাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা প্রয়োজন, যাতে এটি সত্যিকার অর্থে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষার এক উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকে থাকতে পারে।
সবার জন্য সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ
বইমেলা হলো জ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা জরুরি। তবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণে অনেক সময় নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বইমেলায় অংশগ্রহণে বাধার সম্মুখীন হয়। এই বৈষম্য দূর করে সবার সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, বইমেলার আয়োজন ও নীতিনির্ধারণে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকা উচিত নয়। প্রশাসন ও আয়োজকদের নিরপেক্ষ থেকে সব লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র ও স্বল্প পরিচিত প্রকাশকদের জন্য ভর্তুকি বা কম খরচে স্টল বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে, যাতে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে কেউ বঞ্চিত না হয়।
এ ছাড়া শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দূরবর্তী পাঠকদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। পাশাপাশি ভাষা ও মতাদর্শগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে সব লেখক ও প্রকাশকের বই প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সর্বোপরি, বইমেলাকে একটি উন্মুক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্বচ্ছ নীতি, নিরপেক্ষতা এবং সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে এটি একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়।