
স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে একটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরেও একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। আজকেও আমাদের কাছে আবেদন জানায়, ডাকে, আমাদের মনে এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। কেন করে? সে কি শুধু এই কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বস্তরে প্রযুক্ত হয়নি? সে কি শুধু এই কারণেই যে বাংলা ভাষা সরকারি সকল কার্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না? না, সেটা নয়, তার চেয়েও বড় তাৎপর্য এখানে আছে। সে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির যে আন্দোলন ছিল শাসকশ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষের নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা তার প্রকাশ লাভ করেছিল। সে জন্যই নিপীড়ন যতদিন আছে, নিষ্পেষণ যতদিন থাকছে, অন্যায় যতদিন চলবে, ততদিন একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে থাকবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন মধ্যবিত্ত তরুণেরা করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মূলশক্তি কোথা থেকে এসেছিল? আন্দোলন যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে, রমনা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, ততদিন প্রবল ছিল না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই গুলি চালনার দিনে যখন এই আন্দোলন রমনা পার হয়ে পুরাতন ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল, পুরাতন ঢাকা পার হয়ে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচকানাচে পৌঁছে গেল, যখন এই আন্দোলনে কৃষকের বিক্ষোভ, শ্রমিক অসন্তোষ মিশে গেল, রিকশাওয়ালা এসে যোগ দিলেন, নিম্নমধ্যবিত্ত এর সঙ্গে যুক্ত হলো তখনই সে প্রবল, দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। এর আগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা একবার আন্দোলন করেছিলেন বেতনের জন্য, বায়ান্ন সালের আগেই, কিন্তু সে আন্দোলন সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং সব বাংলাদেশে ছড়িয়েও যায়নি। কেন যায়নি? পুলিশের ওপর কম নির্যাতন হয়নি, পুলিশদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দোলন বিস্তৃত হলো না এই জন্য যে তা সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি কর্মচারীর একাংশের মধ্যে। এবং এই যে একুশের আন্দোলন এত প্রবল হলো, দুর্দমনীয় হলো সে যে এতদূর এগিয়ে এলো তার কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সব মানুষের বিক্ষোভ জড়িত ছিল।
আমরা যদি আজকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়িয়ে আমাদের পুরোনো ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব একুশে ফেব্রুয়ারির এই যাত্রাপথ ধরে নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছে। নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়েছে, সেও আমরা জানি। কিন্তু এককভাবে এদের কোনোটাই একুশের একক অবদান নয়।
একুশের মূল সৃষ্টি যদি চিহ্নিত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। এবং সে চেতনাকে যদি চিহ্নিত করতে চাই, তবে তার পরিচয় দিতে হবে কতগুলো লক্ষণ দ্বারা- সে ছিল ইহজাগতিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক, সে চেতনা ছিল অন্যায়বিরোধী, বিদ্রোহী। এবং সর্বোপরি সে ছিল সৃজনশীল। এই যে ইহজাগতিকতা, গণতান্ত্রিকতা, বিদ্রোহের চেতনা, এই যে সৃজনশীলতা এর সবকিছুকে একত্র করেই একুশের পরিচয়। এতকাল আমাদের অনুভূতিগুলো নানা ধরনের আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী পথে বিচরণ করত। ধর্ম ছিল আমাদের একটা বড় সাংস্কৃতিক উপাদান। সেখানে ভাষা এসে আমাদের বস্তুজগৎ ও চারিদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করল এবং যে গণতান্ত্রিক চেতনা এলো সেটা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। আগে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভাগাভাগি ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানগুলো আলাদা, প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা এবং তারা আলাদা আলাদা থাকতেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে ভেঙে দিল। সব মানুষের গণতান্ত্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যায়ের, শোষণের ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো। এসব কিছুকে, ইহজাগতিকতাকে, গণতান্ত্রিকতাকে, বিদ্রোহকে সম্মিলিত করে সে একটা নতুন সৃজনশীলতার জন্ম দিল। সেই সৃজনশীলতার পথ ধরেই আমরা দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ওই পথেই আমরা দেখেছি আমরা এগোতে পারছি, একটা নতুন সমাজব্যবস্থা চাইছি, একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে যাচ্ছি। কাজেই একুশের প্রধান সৃষ্টি কোনো সংগঠন নয়, প্রতিষ্ঠান নয়। কোনো একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা তাকে দেখব না। সে একটা নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিল, সেই চেতনা সৃষ্টিমুখর।
একুশে ফেব্রুয়ারি আরো কাজ করেছে, একটা বিভাজনের রেখা আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিভাজনটা হচ্ছে আলোর সঙ্গে অন্ধকারের, তারুণ্যের সঙ্গে বার্ধক্যের, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে আলো ও অন্ধকার, তারুণ্য এবং বার্ধক্য, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে গেছে- একুশের মানদণ্ডে।
একুশে ফেব্রুয়ারি তারুণ্য এবং বার্ধক্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। তারুণ্য এখানে বয়সের নাম নয়, একটি শক্তির নাম। আর তারুণ্যের গুণ যে সৃজনশীলতা, একুশে ফেব্রুয়ারি সেই গুণে গুণান্বিত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুঃসাহস দেখেছি মানুষের, সৃজনশীলতা দেখেছি তারুণ্যের। সেজন্য তারুণ্যের চিহ্নে একে চিহ্নিত করতে চাই। আমরা তখনই দুঃসাহসী হই, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যেমন আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি। আমরা যখন আলাদা, বিচ্ছিন্ন, যখন পরস্পর পরস্পরের শত্রু, তখন আমরা সকলেই ভীরু, সন্ত্রস্ত। যখন আমরা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, এক হতে পারি, যখন আমাদের চেতনা একসঙ্গে গ্রথিত হয়, তখনই আমরা দুঃসাহসী হয়ে উঠি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দুঃসাহসকে আমরা দেখেছি। কাজেই আবার আমরা দুঃসাহসী হতে পারব, যখন আমরা সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারব।
একুশে ফেব্রুয়ারি একটা প্রশ্ন রাখে আমাদের সবার সামনে। সেটা হলো আমরা কে কোন পক্ষে। আলো, নাকি অন্ধকারের? যদি আলোর পক্ষে হই তাহলে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন না করলে দেশ কেমন করে এগোবে। প্রশ্নটা শুরুতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে আগামীকালও।
একুশের আন্দোলন যে শেষ হয়ে যায়নি তার প্রমাণ একুশের লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। হ্যাঁ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে বৈকি, কিন্তু সর্বত্র সে প্রযুক্ত হচ্ছে না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিণতিতে আমরা নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু এই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন অত্যন্ত বিপন্ন, গণতন্ত্র গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের মতো, আছে বলা হয়, কিন্তু আসলে নেই।
মাতৃভাষার মর্যাদা আমরা তখনই প্রতিষ্ঠা করতে পারব যখন আমাদের এই রাষ্ট্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক হবে। পুঁজিবাদী বিশ্ব আমাদের গণতান্ত্রিক হতে দেয় না। আমাদের শাসকশ্রেণির সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা কখনো নির্বাচিত কখনো অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দেয়, যাতে করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে পারে, এবং দেশকে একটি বৃহৎ বাজারে পরিণত করা সম্ভব হয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব এ রাষ্ট্রকে স্বাধীন হতে দিচ্ছে না, তাঁবেদার করে রাখছে। অথচ একুশের আন্দোলনের মূল প্রেরণাই ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সেদিন বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ভয়ংকর অপচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।
আন্দোলন চলছে এবং চলবে। নদীতে যেমন ঢেউয়ের পরে ঢেউ ওঠে, এখানেও তেমনটা ঘটা চাই। ঢেউ যদি না থাকে তবে বুঝতে হবে নদী নেই, সে মারা গেছে।