Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১০:০৮

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনও করেছে। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অতি সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়েই ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছিল, তার ওপর একটি রিভিউ পিটিশন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকায় তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা যাবে না। বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না, ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৯১ সালে তা সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয়। হাইকোর্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোটের বিধানের পুনরুজ্জীবন হলো। 

দলনিরপেক্ষ লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন শুরু হয়েছে ১৯৯০ সাল থেকে; কিন্তু ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় একে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অভিধায় সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে অবৈধ ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগ সরকার এই রায়কে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। 

পাকিস্তান আর বাংলাদেশ, এই দুটি দেশে যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় বলেই ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনে পতন হয়েছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের। এ দেশে গণ-আন্দোলনে পতন হয়েছে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং শেখ হাসিনা সরকারের। এদের সবাই গণ-আন্দোলনে ‘স্বৈরশাসক’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে একদল আরেক দলকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের। 

বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ করেছিল, ক্ষমতায় বসল বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ‘স্বৈরাচারী’ এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একযোগে আন্দোলন করেছে; অথচ ক্ষমতায় বসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে অস্বীকার করে। 

গণ-আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে পদত্যাগ করলে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পায় এবং বিএনপি যথারীতি কারচুপির অভিযোগ তোলে। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির জয়ে আওয়ামী লীগ স্থূল কারচুপির অভিযোগ আনে। 

যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিএনপির ১৫ বছরের সংগ্রাম, সেই বিএনপি নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পাওয়ার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে পছন্দের বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করতে না পেরে বিএনপি তাদের দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার গুরুত্ব ‘জিরো’ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ছিল না বলেই প্রতিবারই সংসদ ছিল বিরোধী দল শূন্য। সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল হয়েছে স্বেচ্ছাচারী ও ফ্যাসিস্ট। তাই নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সর্বজনস্বীকৃত ব্যবস্থা নয়। 

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নতুন যে প্রস্তাব করেছে তা তাৎপর্যপূর্ণ; কোনো নির্বাচনী আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। কোন বিবেচনায় ৪০ শতাংশের সুপারিশ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিবেচনায় কমপক্ষে ৫১ শতাংশ ভোট না পড়লে তা বাতিলের ব্যবস্থা থাকা উচিত। সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকারের নেতৃত্বে গঠিত সংসদীয় কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই জবাবদিহি থাকা দরকার; কিন্তু এই দায়বদ্ধতা নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবে কি না তাও বিচার্য। আরো একটি ভালো প্রস্তাব হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সংগঠন এবং বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করা। কিন্তু আইনজীবী, চিকিৎসক বা সাংবাদিকদের সংগঠন কেন বাদ দেওয়ার সুপারিশ হলো না? নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন হলে প্রার্থিতা বাতিলের যে সুপারিশ করা হয়েছে তা যথার্থ। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় দেখিয়ে মিডিয়াসহ ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে কমিশনের রিপোর্টে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪-এর 

প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনে প্রার্থীর হলফনামায় মিথ্যা বয়ান বা তথ্য থাকলে প্রার্থিতা বা সংসদ সদস্যদের সদস্য পদ বাতিল করা গেলে মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডিজিটাল আইনে শাস্তি হবে না কেন? রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কারের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাও অপরিহার্য। সব দলই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, কিন্তু কোনো দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই, দলের শীর্ষ নেতার কথায় দলের অন্য সবাই ওঠবস করে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রাথমিক সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত তিনজনের প্যানেল থেকে দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড একজনকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে- সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশও যথার্থ। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে মনোনয়ন প্রদানে আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল, পরে বাদ দিয়েছে। কারণ তৃণমূল পর্যায়েও টাকার খেলা চলে। নির্বাচনে ‘টাকার খেলা’ বন্ধ করার নিমিত্তে শুধু ব্যানার, পোস্টার, তোরণ ও বিলবোর্ড বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিশন, অন্যান্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-নৈতিকতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-নৈতিকতা থাকলে মনোনয়ন বাণিজ্যের হাট বসত না, বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনে টাকার লেনদেন থাকত না, বা ব্যবসায়ী ও ধনীরা একচেটিয়া মনোনয়ন পেত না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নির্বাচনী ব্যয় ব্যাংকিং সিস্টেমের আওতাভুক্ত করার নির্দেশনার বাস্তবায়ন শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তবও। মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনী ব্যয়ের মনিটরিং ও নজরদারির সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে দুর্নীতির আরেকটি নতুন দুয়ার খুলবে। 

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একতরফা ও পাতানো নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা, আইসিটি আইনে সাজাপ্রাপ্তদের কোনো দলের সদস্য না করা, গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের নির্বাচনের বাইরে রাখার বিধানের সুপারিশও করেছে কমিশন। শুধু কি এই তিনটি নির্বাচনই একতরফা ছিল? জিয়াউর রহমানের ‘হাঁ-না’ ভোট, এরশাদ সাহেবের প্রতিটি নির্বাচন, বিএনপির মাগুরার উপনির্বাচন, খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও একতরফা ও পাতানো ছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গায়েবি মামলার জন্যও সংস্কার কমিশন শুধু আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে; কিন্তু ২০০৪ সালে বিএনপির আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। অন্যদিকে গায়েবি মামলা তো বর্তমান অন্তর্বর্র্তী সরকারের আমলেও হচ্ছে। তাই একতরফা ও পাতানো সব নির্বাচনকেই বিবেচনায় নেওয়া সমীচীন। অপহরণ ও গুম একটি জঘন্য অপরাধ, এই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। 

রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গত ১৫ বছরে দলীয়করণের চিত্র সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু মাত্রা কমবেশি হলেও দলীয়করণ আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। দলীয়করণের কারণেই প্রতিটি সরকারের আমলে শত শত আমলাকে ওএসডি করা হয়েছে। নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন রোধ করার যে বাসনা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন তার সফলতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলোতে নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের ইচ্ছা, আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক। কিন্তু হবে না। কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে, ক্ষমতায় যারা যাবে তারা তাদের সংস্কারে নিজেদের আদর্শের প্রতিফলন ঘটাবে এবং এটাই স্বাভাবিক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫