
ফ্লোরা সরকার। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে লিখতে বসলে সবার আগে পুরুষের কথা মাথায় আসে। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশের জনগণ শুধু নারী বা পুরুষ দিয়ে গঠিত নয়। এমনকি প্রাণীজগৎও নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত। একটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব, বিশ্ব নারী দিবস দিয়ে প্রথমেই নারীকে পুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন বা পৃথক করে দেওয়া হয়। এই বিচ্ছিন্নতার জায়গাটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যখনই আমরা সমাজের কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে পৃথক করে দিব, তখন তাকে আর সাধারণ মানুষ হিসেবে গণ্য করব না। অর্থাৎ হয় সে (নারী) আর ১০টা সাধারণ মানুষ (পুরুষ) থেকে অসাধারণ অথবা নিম্নমানের; এ ধরনের একটা বিভাজনের সৃষ্টি হয়।
এই বিভাজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে দুটো ভাগে ভাগ করে দেয়। ফলে দুই ধরনের মতাদর্শিক মানুষ দেখা যায়- একদল (কট্টর নারীবাদী) নারীকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে পুরুষ সেখানে একটা বিন্দুর মতো গৌণ অবস্থানে থাকে। এসব নারীবাদীদের একটাই লক্ষ্য থাকে, সেটা হলো শুধু পুরুষের সমালোচনা বা খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। যেকোনো ঘটনায় পুরুষকে আগে দোষারোপ করা। আরো ভয়াবহ হলো, এসব নারীবাদীর এমন একটা ভাব পুরুষ ছাড়াও তারা নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পারে। পুরুষ তাদের জীবনে একটা ঝামেলা আকারে দেখা দেয়। যে কারণে পাশ্চাত্যে সিঙ্গল মাদার ব্যবস্থাকে খুব স্বাভাবিক একটা ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়। অথচ শিশু কিন্তু নারী বা পুরুষ কিছুই বোঝে না, সে শুধু বোঝে বাবা ও মা। তার দুজনকেই প্রয়োজন।
একটা সমাজে নারী-পুরুষ দুজনকেই প্রয়োজন। অন্যদিকে সমাজে কিছু পুরুষ বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে দেখা যায়, যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথমেই নারীকে দোষারোপ করে বসে। এর সব থেকে বড় উদাহরণ, যখন কোনো ধর্ষণের (ধর্ষণ একটা সামাজিক ব্যাধি) ঘটনা ঘটে, ধর্ষিতার পরিচয় আমরা সবার আগে পেয়ে যাই, ধর্ষক থাকে অন্তরালে। পরে সামাজিক চাপে তার পরিচয় বের হয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে ধর্ষকের কোনো শাস্তির খবর আমরা আর পাই না। বরং প্রথম দিকে নারীকে দোষারোপ করা হয়। যদিও এই ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষকের শাস্তির বিষয়ে এখনো নীরব ভূমিকা পালন করা হয়। পারিবারিক কলহের ক্ষেত্রেও (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদের ক্ষেত্রে) স্বামীর চেয়েও স্ত্রীর দোষ আগে খোঁজা হয়। এই দুই চরমস্তরের কারণে নারী বা পুরুষ কারোর সমস্যাই সেভাবে শনাক্ত করা যায় না।
মোটামুটি সব ধর্মেই নারীকে উচ্চাসনে বসানো হয়েছে। আমরা যদি হিন্দু ধর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালী ইত্যাদি ধর্মীয় দেবীদের অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সম্মানের সঙ্গে চিত্রিত করা হয়েছে। দুর্গার দেবীর ১০ হাত অত্যন্ত প্রতীকী একটা মূর্তি। বাস্তবে কোনো নারীর ১০ হাত নেই ঠিক, কিন্তু একজন নারী তার দুই হাত দিয়ে ১০ হাতের কাজ করতে পারে। একইভাবে সরস্বতীকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতীক, লক্ষ্মীকে প্রাচুর্যের প্রতীক এবং মা কালীকে শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। দেব অর্থাৎ পুরুষ এখানে অনুপস্থিত।
একইভাবে খ্রিস্টান ধর্মে বিবি মরিয়মকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ইসলাম ধর্মে নারীর উপস্থিতি আরো আকর্ষণীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। যেমন- সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ এবং তোমরা তাদের আবরণ।’ আমরা যদি আরো গভীরে যাই তাহলে দেখব, আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দুটো উক্তি দুই জায়গায় পাই। যেমন- মুসলিম শরিফে আমরা একটি উক্তি পাই, নবীজি (সা.) বলছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক’ এবং তিরমিজি শরিফে পাই, তিনি বলছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ উক্তি দুটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব, এখানে নারী ও পুরুষ কাউকে ছাড় দিয়ে কিছু বলা হয়নি।
ভালো নারী একটা পরিবারে যেমন সৌভাগ্য এবং আশীর্বাদ নিয়ে আসে, ঠিক তেমনি একজন পুরুষ ভালো বা মন্দ সেটা বোঝা যায় তার স্ত্রীর দৃষ্টিকোণ দিয়ে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক এমন পরিচ্ছন্নভাবে খুব কম মানুষ ফুটিয়ে তুলেছেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে আমরা দেখতে পাই, নাটকের শেষ দিকে চিরকুমারেরা নারীর অভাব এমনভাবে বোধ করে যে তারা আর চিরকুমার থাকতে পারে না, বিয়ে করে নারীর সংস্পর্শে আসতেই হয়। এমনকি সেখানে একজন চিরকুমারীও আর কুমারী থাকতে পারে না, সে-ও পুরুষের সংস্পর্শে এসে তার কুমারিত্বের ব্রত ভেঙে ফেলে। সমাজে নারী-পুরুষের বিভেদ মেটাতে হলে যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন তা হলো, পারস্পরিক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা বা সম্মানবোধ। দুজন দুজনের প্রতি যতদিন না পর্যন্ত এই সম্মান অর্জন করতে পারবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি অযথা স্লোগান দিয়ে যেতে হবে। আসলে মানুষ এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। যদি মানুষ হয়ে উঠত, তাহলে নারী যে পুরুষের মতোই একজন মানুষ, এই উপলব্ধি করতে কোনো বেগ পেতে হতো না।