Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

নতুন দল, প্রত্যাশা ও সংশয়

Icon

রাজেকুজ্জামান রতন

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৯

নতুন দল, প্রত্যাশা ও সংশয়

রাজনীতিতে দাবি উত্থাপন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। দাবি আন্দোলনের মধ্য থেকে উত্থাপিত হয়, আন্দোলনের পরও উঠতে পারে। যেমন- আন্দোলনে দাবি উঠেছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ করতে হবে, আন্দোলনে বিজয়ের পর দাবি উঠেছে সংস্কার করতে হবে এমনভাবে যাতে আর ফ্যাসিস্ট সরকার গড়ে উঠতে না পারে। 

নতুন গঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কিছু রাজনৈতিক দাবি এখন আলোচনায় এসেছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে কি সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা করা হবে? ক্ষমতাচ্যুত, পলাতক ও গ্রেপ্তারকৃতদের বিচার করার পরে কি নির্বাচন হবে? দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ কী হবে?   

জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করার জন্য যেমন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, তেমনি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই আবার জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে। পুরোনো ব্যবস্থা ভাঙার জন্য রাজনৈতিক দলের সংগ্রামের পাশাপাশি নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার জন্যও রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ হতে পারে; কিন্তু রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন প্রাথমিক বিজয় অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না, সেই বিবেচনায় গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই নতুন দল গড়ার ঘোষণা ছিল। অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ ঘটল সেই দলের।  বিপুল আয়োজন ও আড়ম্বর করে গঠিত ও ঘোষিত নতুন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুরোনো দল আর পুরোনো চিন্তা দিয়ে চলবে না। ফলে নতুন দল চাই, চাই নতুন ধরনের সরকার। 

ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে গণ-অভ্যুত্থান করেছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। জীবন দিয়েছে, নির্যাতন সয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতি ঘৃণা আর বৈষম্যবিহীন দেশ গড়ার প্রত্যাশায়। বাংলাদেশে যত সমস্যা আছে তার রূপ যাই হোক না কেন প্রকৃতি তো একই। সমাজটা পুঁজিবাদী ও শোষণমূলক ফলে বৈষম্য সর্বত্র। বৈষম্য নারী পুরুষের, পাহাড়-সমতলের, গ্রাম-শহরের, ধর্মীয় ভিন্নতায়, সরকারি-বেসরকারি এবং প্রধানত ধনী-গরিবে। বৈষম্যের প্রকাশ হিসেবে প্রতিটি স্তরেই সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করেছে। বৈষম্য মাপার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে দুই পদ্ধতি গিনি সহগ এবং পালমা মেথড উভয় বিবেচনাতেই বাংলাদেশের বৈষম্য এখন চরম আকার ধারণ করেছে। বৈষম্য থেকে মুক্তির আকুতি নিয়েই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের জনগণ অংশ নিয়েছিল।   

জনগণের ক্রোধের সামনে আওয়ামী লীগ সরকার তার সব শক্তি নিয়েও দাঁড়াতে পারেনি, পালিয়ে গেছে দেশ ছেড়ে। কিন্তু যাওয়ার আগে যতদূর সম্ভব অর্থনৈতিক ক্ষতি করে গেছে। পতন ও পলায়নের পর দেখা গেল, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়েছিল, অবিশ্বাস্য ও অস্বাভাবিক পরিমাণ লোন নিয়ে ব্যাংকগুলো এবং দেশের জনগণের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতি করা হয়েছে আকাশছোঁয়া। ফলে দেশের জনগণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে এবং ভরসা রাখতে চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। কিন্তু ভরসায় যেন ফাটল দেখা দিয়েছে। কারণ প্রত্যাশিত ও দৃশ্যমান সুফল দেখা যায়নি এখনো।    

আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মাজার ভাঙা, নারীদের ওপর আক্রমণ ও নানা বিধিনিষেধ প্রবর্তন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা আর প্রতীক্ষার বুঝি শেষ হবে না। স্বাধীনতার পর ১২টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি এখনো। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার কারণে নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। পাশাপাশি এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করে না। নির্বাচন কমিশন যতই সাংবিধানিকভাবে তৈরি এবং নিরপেক্ষতার কথা বলুক না কেন, ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন এবং জলিয়াতির নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন। ফলে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম প্রধান শর্ত স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি নির্বাচন কমিশন।  

অতীতের নির্বাচনগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার সহযোগিতা না করলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ক্ষমতা আছে কি না সেই পরীক্ষা বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনগুলো এখনো দিতে পারেনি। তাই ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে যে চারটি নির্বাচন আপাত গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেওয়া যায়, সেসব নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সে বহুদিন আগের কথা। যাদের বয়স এখন ৩৪-৩৫, তারা জীবনে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখেননি।  অবিশ্বাস্য হলেও এটি সত্য। সে কারণেই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগকে যে পরাজিত করা যাবে না, তা দেশের মানুষ বিশ্বাস করেছিল। ফলে নির্বাচন নয়, গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল আন্দোলনকারী জনগণের কাছে। 

অভ্যুত্থানের পর তাহলে সরকারের চরিত্র কী হবে? কতদিন থাকবে এই সরকার, এই বিতর্ক এখনো থামেনি। সরকার কি অভ্যুত্থানকারী দল ও সংগঠনের সরকার, নাকি বিপ্লবী সরকার, না অন্তর্বর্তী হবে, সেই প্রশ্নে একটা আপাত সমাধান হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। সরকারে আছেন এমন কিছু ব্যক্তি যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, কেউ কেউ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামে ছিলেন না, অনেকেই এনজিও ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত এবং তিনজন ছাত্র আন্দোলন সংগঠক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রথম ছাত্ররা সরকার পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত হয়েছে। ফলে কিছু বিতর্ক যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে তা নিয়ে সন্দেহও তৈরি হয়েছে যথেষ্ট। 

কোনটা আগে হবে সংস্কার না নির্বাচন? বলা হচ্ছে সংস্কার না করে নির্বাচন হবে না। ঠিক তেমনি আবার বলা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দোসরদের বিচার না করে নির্বাচন করা যাবে না। আবার নির্বাচন হলে কোনটা আগে হবে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন না জাতীয় নির্বাচন? এসব বিতর্ক কি আসলেই প্রয়োজনীয়, না সময়ক্ষেপণের কৌশল, তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। 

কারণ সংস্কার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বিচারও তাই। এসব শেষ করে নির্বাচন করতে হলে এই সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে হবে। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যে সহিংসতা হয় তা কি বর্তমান সরকার সামাল দিতে পারবেন, নাকি নতুন সংকট তৈরি হবে? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না? মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা কি আবেদন হারিয়েছে? কেন জাতীয় সংগীত, দেশের নাম পাল্টানো, সংবিধান পরিবর্তন, পুনর্লিখন প্রয়োজন হবে, এই প্রশ্নগুলো উঠছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠিত হবে সেখানেই তো সংবিধান সংশোধন করে বর্তমান সরকারকে আইনগত বৈধতা দিতে হবে। ফলে নির্বাচনের যত দেরি হবে জটিলতা ততই বাড়বে। অভ্যুত্থান কোনো আইন মেনে হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু দেশ পরিচালনা করতে গেলে তো আইন-কানুন প্রয়োজন হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা রাজনৈতিক জটিলতা বাড়াবে। নতুন দল যে প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠছে এবং যেসব বিতর্ক উত্থাপন করছে তা কিন্তু নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। এই বিষয়টি ভাবনায় থাকা দরকার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫