Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

হিযবুত তাহরীর হঠাৎ কেন প্রকাশ্যে?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৪

হিযবুত তাহরীর হঠাৎ কেন প্রকাশ্যে?

আমীন আল রশীদ

নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে গোপনে তাদের কার্যক্রম চালালেও গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তারা বেশ প্রকাশ্যে এসেছে।

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই ঢাকায় মিছিল করে হিযবুত তাহরীর। পরদিন সকালে তারা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ৭ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে খিলাফতের দাবিসংবলিত ব্যানার-লিফলেট নিয়ে সভা করে। একই দিনে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনেও সভা করে। আগস্টে বন্যার সময় ‘ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদ’ শীর্ষক ব্যানারে ঢাকায় বড় বিক্ষোভ মিছিল করে সংগঠনটি। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ গুঁড়িয়ে হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানো হয়। চট্টগ্রামেও পালন করেছে নানা কর্মসূচি।

সবশেষ গত শুক্রবার (৭ মার্চ) জুমার নামাজের পরে ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি ঘিরে তাদের মিছিল এবং পুরো রাজধানী শহর পোস্টারে ছেয়ে ফেলার ঘটনা বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন- এই সময়ে এসে তারা কেন প্রকাশ্য হলো? গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরের মাসেই তারা তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে আবেদন করেছে। যদিও এ বিষয়ে সরকারের তরফে কোনো বক্তব্য আসেনি। প্রশ্ন হলো, তারা এই সরকারের আমলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন জানাল কেন? তারা কি মনে করছে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে? এই বিশ্বাস তাদের মধ্যে কী করে তৈরি হলো? তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারির মতো গোয়েন্দা সামর্থ্য আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

দেশ যেহেতু একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় পার করছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক; প্রশাসনের মধ্যেও সক্রিয়তার অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাজনিত ভীতি; এসবের সুযোগ নিয়ে কি হিযবুত তাহরীর বা এ রকম আরো অনেক ধর্মীয় ও কট্টরপন্থি দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে?

খেয়াল করলে দেখা যাবে, শুধু হিযবুত তাহরীর নয়, ৫ আগস্টের পরে অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও সংগঠন অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ‘তৌহিদী জনতা’ নাম দিয়ে যারা মব তৈরি করছে, নারীদের হেনস্তা করছে, নিজেদের বিশ্বাস ও মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের সঙ্গে ওই সব ধর্মীয় দল ও সংগঠনের কোনো না কোনো সংযোগ রয়েছে। অনেকের আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, দেশে শরিয়া আইন চালু হয়ে গেছে। এর কারণ কী?

অস্বীকার করা যাবে না, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংঘটিত জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামীবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন সক্রিয় ছিল। কৌশলগত কারণে তাদের অনেকে সেটি আন্দোলন চলাকালে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, ওই আন্দোলনে সরকারবিরোধী সব দল ও সংগঠনেরই কমবেশি ভূমিকা ছিল। বিশেষত জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনসহ হিযবুত তাহরীরও।

যেহেতু তাদের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি বিরাট শক্তির পতন হয়েছে, ফলে এখন তারা তাদের দলীয় আদর্শ ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তারা কি এটা ভাবছে যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের ওই সব ধর্মীয় ও দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলে অন্তর্বর্তী সময়টাই আদর্শ?

প্রসঙ্গত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সরকার ও শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়। তাদের শাসনব্যবস্থার প্রস্তাব হলো একক ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা, যা বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী প্রচারণা এবং সহিংস আন্দোলনের ডাক দেওয়ার কারণেও তাদের বিপজ্জনক মনে করা হয়।

গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে যখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট তীব্র হয়, তখন হিযবুত তাহরীর একটি পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল : ‘ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র ঘোষণা করো’।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র ঘোষণার পরিণতি কী হতে পারে বা কাউকে শত্রু ঘোষণার পরে সে যদি আক্রমণ করে এবং তখন যদি যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হয়, তার পরিণতি কী হতে পারে, এসব সাধারণ বিষয় নিয়েও যারা ভাবে না, তাদের বিপজ্জনক মনে করাই সংগত।

হিযবুত তাহরীরের পোস্টারে সাধারণত সেনাবাহিনীর প্রতি বিভিন্ন আহ্বান থাকে। তারা একই সঙ্গে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে। এসবের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে, তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চায় এবং প্রচলিত পদ্ধতি তথা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কিংবা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের জনপ্রিয় হওয়া যেহেতু কঠিন, ফলে এক ধরনের সংঘাত বা নৈরাজ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে চায়। যার সবশেষ উদাহরণ ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি। শোনা যায়, সেনাবাহিনী ও পুলিশ অ্যাকশনে না গেলে এদিন তারা বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যেত।

গত ৭ মার্চের ওই কর্মসূচির বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই তারা রাজধানীর মূল সড়কের আশপাশে তো বটেই, অলিগলিতেও তাদের নির্দিষ্ট কালো ও কমলা রঙের পোস্টারে ছেয়ে ফেলে। শোনা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তাদের এই কর্মসূচির ক্যাম্পেইন চলেছে। যদিও সরকারের তরফে শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল যে, নিষিদ্ধ এই সংগঠনকে কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। কর্মসূচির আগের দিন রাজধানীর উত্তরা থেকে সংগঠনের তিন কর্মীকে গ্রেপ্তারের কথাও জানায় পুলিশ।

এ রকম বাস্তবতায় শুক্রবার জুমার নামাজের আগে থেকেই বায়তুল মোকাররম এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী। গণমাধ্যমের খবর বলছে, জুমার নামাজের সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গেই সড়ক ও বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সিঁড়ির ওপর নামাজে দাঁড়ানো হিযবুতে তাহরীরের কর্মীরা স্লোগান দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারা হাতে তুলে নেয় কালিমা খচিত ব্যানার। প্রথমে পুলিশের একটি ছোট দল তাদের বাধা দিতে গেলে তারা সেই বাধা ভেঙে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়। তবে তাদের মিছিলটি পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগরের দিকে যাওয়ার সময় যৌথ বাহিনী অ্যাকশনে যায় এবং মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

পরদিন বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, শুক্রবার থেকে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের অন্তত ৩৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার কারণে নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক সাইফুল ইসলামও রয়েছেন। দলটির সদস্যদের ধরতে পুলিশ দেশব্যাপী অভিযান শুরু করেছে। পুলিশ সমাবেশের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে। হিযবুত তাহরীরের অনেক সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংগঠনটির সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে পুলিশ।

১৯৫৩ সালে জর্ডানের শাম শহরে প্রতিষ্ঠিত হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০০১ সালে এবং সরকার এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে ২০০৯ সালে। ওই বছরই সংগঠনের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমেদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল ফার্মগেটে তার বাসভবন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৩ মে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক জড়িত। এমনকি অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীও এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং আগামী দিনগুলোতে সরকার এই সংগঠনকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের বিস্তৃতি। তবে গত ৫ আগস্টের পর থেকে তারা যেভাবে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে, সেটি খুব ভালো লক্ষ্মণ নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫