ফিরে দেখা এক টুকরো ইতিহাস
প্রসঙ্গ: ’৪৭-এর দেশভাগ

রইসউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৫:০০

বলা হয়ে থাকে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছিল জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ কারণে। কিন্তু এটি প্রকৃত সত্য নয়। দেশ ভাগ হয়েছিল মূলত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের ‘একজাতি’ তত্ত্বের কারণে। জিন্নাহ যখন কংগ্রেসে ছিলেন, তখন কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে, বলতে গেলে ওই একজন জিন্নাহই ছিলেন পুরোপুরি সেক্যুলার নেতা। এ জন্যই তখনকার গুরুতুল্য দুই কংগ্রেস নেতা গোখলে ও সরোজিনী নাইডু জিন্নাহকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ খেতাব দিয়েছিলেন। জিন্নাহর কথা ও অঙ্গীকার ছিল- ‘আমি প্রথমে ভারতীয়, পরে মুসলমান।’ জিন্নাহর আরো অঙ্গীকার ছিল- ‘আমরা হিন্দু-মুসলমানসহ সবাই ভারতবর্ষের সন্তান, আমাদের একত্রে বসবাস করতে হবে।’
কিন্তু উনিশশ তিরিশের দশক থেকেই হিন্দুত্ববাদী নেতারা ভারতবর্ষকে শুধু একজাতি- হিন্দু জাতির দেশ বলে ঘোষণা দেওয়ার ফলে জিন্নাহকে দেওয়া ‘খেতাব’ শুধু বেনোজলেই ভেসে যায়নি, উপরন্তু দেশভাগ অবধারিত করে তুলেছিল। বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু জাতির দেশ ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে ঘোর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
দুই.
জিন্নাহ প্রথম দিকে গান্ধী ও নেহেরুর সঙ্গে একত্রে কাজ করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু আপাদমস্তক সেক্যুলার নেতা জিন্নাহ ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে গান্ধী ও নেহেরুর মনোভাব যতটা দৃঢ় ও শক্তিশালী, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হলো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ‘একজাতি-হিন্দুজাতি’র মনোভাব। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে এই মনোভাব কীভাবে প্রকাশ ও মূর্ত হয়ে উঠেছিল এবং দেশভাগকে কীভাবে অবধারিত করে তুলেছিল, তার কিছু নজির অতিসংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা যাক-
প্রথমত, ১৯৩৩ সালে ‘ভারতীয় হিন্দু মহাসভা’র আজমির অধিবেশনের সভাপতি ভাই পরমানন্দ দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করেন, ‘হিন্দুস্তান (ভারতবর্ষ) হলো হিন্দুর। মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যরা যারা হিন্দুস্তানে বসবাস করে, তারা হলো বহিরাগত। হিন্দুস্তানে বসবাস করতে হলে তাদের আগন্তুক (outsider) হিসেবে থাকতে হবে।’ (jana sangh ‘Biography of an Indian party’ গ্রন্থে লেখক Graig Baxter কর্তৃক উদ্ধৃত।
দ্বিতীয়ত, ১৯৩৮ সালে হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে বিনায়ক দামোদর সাভারকার ঘোষণা দেন, ‘ভারতবর্ষ হচ্ছে হিন্দুস্তান, হিন্দুদের পবিত্র পিতৃভূমি। ভারতবর্ষে কেবল একটিই জাতি আছে তার নাম হিন্দু জাতি। মুসলমান বা অন্য আর কেউ জাতি নয়। (‘Travel for freedom’ গ্রন্থে লেখক রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক উদ্ধৃত)।
তৃতীয়ত, ১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক গুরু, গুরুমাধব সদাশিব গোলোয়ালকার, তার লেখা ‘we or our Nationhood’ গ্রন্থের ৯-১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘কোনো বহিরাগতদের আগমনের আগে আমরা হিন্দুরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ও নিরাপদে ৮ হাজার বা ১০ হাজার বছর যে দেশে বাস করেছি, তার নাম হিন্দুস্তান। এই দেশ শুধু হিন্দুদের।’
বলা বাহুল্য, হিন্দুত্ববাদীদের এই ধরনের মিথ্যা দাবি ও ঘোষণার এ রকম বহু নজির আছে।
আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই যে, ‘একজাতি-হিন্দু জাতি’র তত্ত্ব, সেটি শুধু হিন্দু মহাসভার নেতারাই ধারণ করতেন না, কংগ্রেসের অনেক নেতারাও ধারণ করতেন। তার প্রমাণ ১৯৩৪ সালের দুটি ঘটনা। প্রথমটি হলো উচ্চপর্যায়ের ও প্রভাবশালী দুই কংগ্রেস নেতা মাধব শ্রীহরি আনে এবং মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে, কংগ্রেসের ভেতরকার উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং গান্ধীর বিরোধিতা করে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে’র নাম পাল্টিয়ে, হিন্দু জাতীয়তার ভিত্তিতে ‘কংগ্রেস ন্যাশনালিস্ট পার্টি’ গঠন করা। দ্বিতীয় ঘটনা হলো, পুনে শহরে গান্ধীকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ করা। এটা ছিল উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের, গান্ধীকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা।
যে জিন্নাহ মনেপ্রাণে ঘোষণা করেছিলেন- ‘আমি প্রথমে ভারতীয়, পরে মুসলমান’। তিনি শুধু হিন্দু মহাসভারই নয়, কংগ্রেসের ভেতরকার সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রবল জাত্যভিমানী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও আচরণের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন যে অন্তত গান্ধী-নেহেরুর মৃত্যুর পরে স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করতে হবে হিন্দুত্ববাদের খড়গের নিচে।
তিন.
এভাবে ব্রিটিশ-ভারতে এবং দেশ ব্রিটিশমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা ইতিহাসবিরোধী ‘একজাতি-হিন্দুজাতি’র মিথ্যা দাবি ক্রমাগতভাবে প্রচার হতে থাকলে ভারতব্যাপী যে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপটেই হিন্দু নেতাদের ‘একজাতি’ তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে একপর্যায়ে জিন্নাহ ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ প্রদান করেছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেছেন- আসল কথা হলো, অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ধরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতারা হিন্দুদের স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ একক জাতি বলে ক্রমাগত দাবি ও ঘোষণা করে, জিন্নাহকে দ্বিজাতি তত্ত্বের কোণে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিলেন। জিন্নাহকে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র স্রষ্টা বলা হয় বটে, কিন্তু হিন্দু জাতিতত্ত্বের প্রবক্তারাই দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রকৃত স্রষ্টা। (সুরজিৎ দাশগুপ্ত : মৌলবাদ এক নতুন সংজ্ঞা, পৃষ্ঠা-৬৯।)
উপসংহার
স্বাধীন বাংলাদেশ, বিশেষ করে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে বসে, উপমহাদেশের রাজনীতির অতীতের এই এক টুকরো ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জন্য পুনর্পাঠ খুবই জরুরি। কারণ আমাদের পুরোনো প্রজন্মের বেশির ভাগের মধ্যে ‘মি. জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম দিয়ে’ ৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে মহাপাতকের কাজ করেছিলেন’-এই ইতিহাসের জ্ঞান টনটনে। কিন্তু কীরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে জিন্নাহ ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন- সেই ইতিহাসের জ্ঞান আমাদের ঠনঠনে। সাতচল্লিশের প্রায় আট দশক পরে খোদ ভারতসহ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দুত্ববাদের ভয়ংকর আগ্রাসী চেহারা দেখে, আজ জিন্নাহর ভবিষ্যদ্বাণীর কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নাকি?