
দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাতের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন দল গঠন নিয়ে সবার মধ্যেই কৌতূহল ছিল। সব কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তারা নতুন দল ঘোষণা করেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের দিনই দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এই দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার।’
দল ঘোষণার পর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা কীভাবে সেকেন্ড রিপাবলিক বাস্তবায়নের পথে এগোবেন। রাজনৈতিক মহলেও বিষয়টি কিছুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে।
সেকেন্ড রিপাবলিক কী
নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের পর এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি গণপরিষদ নির্বাচন দেখতে চান। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন দেখতে চান নির্বাচনের আগে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ফরিদুল হক একটি গণমাধ্যমে সেকেন্ড রিপাবলিক কেন, তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, এরই মধ্যে এনসিপি তার ঘোষণাপত্রে দলের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছে। এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, আমরা কি নতুন করে রাষ্ট্র বানাচ্ছি যে গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে কিংবা ফার্স্ট রিপাবলিক কি বাতিল হয়ে গেছে যে সেকেন্ড রিপাবলিক লাগবে?
তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে দুইটারই উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। অবশ্য যারা জুলাই পার করে এসেছেন, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন, যাদের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন, যাদের আহত শরীর বাকি জীবনের জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছে, তাদের কাছে এ প্রশ্নেরই হয়তো প্রয়োজন নেই। তারা প্রশ্ন ছাড়াই বোঝেন, যে রিপাবলিকের প্রতিটি পয়সার জোগান দিতেন যারা, তাদেরই পয়সায় কেনা বন্দুক দিয়ে তাদের সন্তানদের বুকে গুলি চালিয়েছে এই রিপাবলিক। এই রিপাবলিকের হাত হাজারো শহীদের রক্তে রঞ্জিত খুনি হাত। একে আর বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না!
দেশে দেশে রিপাবলিক
সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা আলোচনায় এলে সবার আগে যে দেশটির নাম উঠে আসে তা হলো ফ্রান্স। রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা ফ্রান্সে ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত চলা ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। বিপ্লব চলাকালেই ১৭৯২ সালে সে দেশে প্রথম রিপাবলিক ঘোষিত হয়। এরপর ১৮০৪ সাল পর্যন্ত সেকেন্ড রিপাবলিক কার্যকর ছিল। পরবর্তী সময়ে আবার রাজতন্ত্র কায়েম হয়। ১৮৪৮ সালে এসে রাজতন্ত্রের পতন হয় ও সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। তবে এই সেকেন্ডে রিপাবলিক ১৮৫২ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে।
এভাবে বিভিন্ন সময় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। তবে শুধু ফ্রান্সই নয়, কোস্টারিকা, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশে একাধিক রিপাবলিক হয়েছে। আবার ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা কি সেকেন্ড রিপাবলিক
বাংলাদেশে সেকেন্ড রিপাবলিকই হতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টির অন্যতম এজেন্ডা। তারা জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে যাবে, তাদের সঙ্গে বসে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে। যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতন ঘটাতে পারেনি, তখন এই ছাত্র নেতৃত্ব ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আর তারাই এখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে মানুষের মনে নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে।
দেশের গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে এসে ছাত্র নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নাগরিক পার্টির প্রতি জনমানুষের নতুন চাওয়া-পাওয়া তৈরি হয়েছে। সেই চাওয়া নাগরিক পার্টি সেকেন্ড রিপাবলিকের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে চাইছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এই নেতিবাচক রাজনীতির বাইরে নাগরিক পার্টির নতুন কিছু উপহার দেবে, সেটাই সবার চাওয়া।
যে সংবিধান একজন প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরশাসক হতে সহায়তা করছে, সেই সংবিধানের বিলুপ্তি চান নাগরিক পার্টির নেতারা। সেকেন্ড রিপাবলিকের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রণয়ন করতে চান তারা।
পক্ষে-বিপক্ষে
সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, ছাত্ররা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরশাসককে বিদায় করতে পেরেছেন, তাদের পক্ষেই নতুন কিছু করা সম্ভব। তারাই পারবে দেশকে নতুন কোনো বন্দোবস্ত উপহার দিতে। তবে ৫ আগস্টের পর সবাই যেভাবে একটি প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখন সেই পরিস্থিতি নেই।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া ছাত্রদের মধ্যেও ডানপন্থি, বামপন্থিসহ বিভিন্ন পন্থার লোকেরা রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে নাগরিক পার্টির মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য কতটা থাকে, তাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য তৈরি করে এগোতে হবে।
বাধা যখন বিএনপি
নাগরিক পার্টির সেকেন্ড রিপাবলিক বাস্তবায়নে গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোই এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে বিদায় করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবির বিরোধিতা করে বসে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এরপর ছাত্ররা গত ৩১ ডিসেম্বর ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণা করার কথা জানায়। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর, না অর নেভার’। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সেই ঘোষণায়ও ভেটো দেয়। ফলে সেই ঘোষণা থেকেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন।
আর এবার নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশের দিন রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে জনসমাবেশে সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণা দেন সংগঠনের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তবে এই ঘোষণা দিতে না দিতে এরই মধ্যে এর বিরোধিতা করে বসেছে বিএনপি।
গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক সঙ্গে হতে পারে বলে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে গত শনিবার খেলাফত মজলিসের ইফতার মাহফিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার, এখানে (একসঙ্গে গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন) কোনো জাতীয় ঐক্য এ বিষয়ে হয়তো হবে না, একটি মেজর পলিটিক্যাল পার্টির সদস্য হিসেবে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হবে সবচেয়ে জরুরি এবং আমাদের অগ্রাধিকার।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘গণপরিষদ হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি ফোরাম। সেই ক্ষেত্রে যেকোনো জাতীয় সংসদের এখতিয়ারই হচ্ছে ‘এ টু জেড’ সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার। সেখানে আমরা শুনলাম, সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনী। এখানে সেটাকে আমরা নতুন সংবিধান বলতে পারি। এটাকে যদি আপনাদের মন চায়, নতুন সংবিধান বলতে পারেন, আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক ডিকশনারি-বহির্ভূত শব্দাবলি অসংলগ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে যেন ধুম্রজাল সৃষ্টি না করি।’
কীভাবে বাস্তবায়ন
নাগরিক পার্টি সেকেন্ড রিপাবলিক বিষয়টিকে সামনে রেখেই ভবিষ্যতে রাজনীতির মাঠ গরম করবে তা অনেকটাই স্পষ্ট। কারণ ২৮ ফেব্রুয়ারি দলের আত্মপ্রকাশ ও পরবর্তী সময়ে ৭ মার্চ যে সংবাদ সম্মেলন করেছে- সবখানেই সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়টিকে সামনে আনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। কারণ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এরই মধ্যে বিরোধিতা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি কোনো ইস্যুতে ঐকমত্য পোষণ না করে সে ক্ষেত্রে রাজপথে গণমানুষের মাঝে বিষয়টির পক্ষে জনমত তৈরি করতে হবে। তবে এ জন্য আগামী দিনে কী কর্মসূচি দেবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো কথা বলেননি দলটির প্রধান নাহিদ ইসলাম।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, ঈদের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত কর্মসূচি আসতে পারে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিক বিষয়টি অনেকটা মাথাব্যথা হলে মাথাটা কেটে ফেলার মতো। রোগ হলে তা সারিয়ে সুস্থ করতে হবে, মাথা কেটে ফেলে নয়।
তিনি মনে করেন, সংবিধানে কোথাও যদি সমস্যা মনে হয়, তাহলে তা সংশোধনের মাধ্যমেই কাজটি করা যায়। এ জন্য নতুন কোনো সংবিধানের প্রয়োজন নেই।
লেখক : উপ সম্পাদক, দেশকাল নিউজ