
মচ্ছব চলছে নারীকে নিয়ে। নারীর শরীর, পোশাক, আচরণ সব কিছু নিয়ে। কারা এরা? এরা কি দেশের মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না? নারী কি তাদের খেলার পুতুল যে যা ইচ্ছা তারা তা-ই নারীর বিরুদ্ধে বলবৎ করতে পারবে?
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে এবং সেই ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠায়। একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন মোজাম্মেল হক মানিক নামের এক শিক্ষক। ৮ মার্চ রাতে কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নিকটাত্মীয়দের দ্বারা মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীদের দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাতে-দিনে প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সড়কে। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিবাদ চলার সময়েও পর পর নারী-শিশু ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা দেশজুড়ে জনমানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে একটি আলোচিত শিশু ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি দিনাজপুরের সাইফুল ইসলামের জামিনে বেরিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাঞ্ছনার আসামি অর্ণব জামিন পেয়ে ফুলের মালা গলায় দুর্বৃত্তের জয়সূচক পোজ দিয়েছে। আমরা ‘নাক কাটা, ঝামা ঘষা’ হয়ে গিয়েছি। এই হলো ক্ষয়িষ্ণু মেরুদণ্ডের লজ্জাজনক উদাহরণ।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে প্রতিদিন গড়ে ১২টি মামলা হয়েছে। গত বছর সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এই আইনে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি। গত বছরের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৩।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম পত্রিকান্তরে বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক অস্থিরতার সময় নারী ও শিশুর প্রতি যৌন-সন্ত্রাস বাড়ে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। ৫ আগস্টের পর অনেক কয়েদি পালিয়েছেন। এখন নারীবিদ্বেষী প্রচারও বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি তো এ দেশে রয়েছেই। এ সুযোগগুলো নিচ্ছে অপরাধীরা। শুধু নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বিষয়ে ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছর নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের দুই হাজার ৫২৫টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে এক হাজার ৬৬৪টি ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৮৬১টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণ, ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ছয়জন।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলার বিচার ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ সনদ প্রয়োজন হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন, শুধু চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি সে রকম ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
নারী নিগ্রহ বন্ধ করার জন্য ধর্ষণ শনাক্ত ও বিচার করার পদ্ধতি জোরদার করলেই কিন্তু এর সুরাহা মিলবে না। যেমনটি দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। সরকার নড়েচড়ে বসলে কম সময়ে বিচার নিষ্পন্ন হয়, কিছু ধর্ষকের শাস্তি হয়। কিন্তু সময়-সুযোগ বুঝে আবার জেগে ওঠে ধর্ষকরা। নারীকে সম্মান করার সংস্কৃতির প্রসারে আমাদের তৎপর হতে হবে। অতএব, এই রোগের বিরুদ্ধে আমাদের ন্যূনতম তিন পর্যায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গ্রামগঞ্জ, ইউনিয়ন পরিষদ, বাজার, জনসমাগমস্থলে কোনো নারী যদি পুরুষের বিরুদ্ধে তার সম্ভ্রমহানি বা এতদসংক্রান্ত গুরুতর কোনো অভিযোগ করেন, তবে সংশ্লিষ্ট পুরুষকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪(১) ধারায় গ্রেপ্তার করার বিষয়ে প্রচার করতে হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হবে, অন্যথায় তাকে অব্যাহতি দানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে থানা থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। প্রয়োজনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারা অনুযায়ী সন্ধিগ্ধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করবেন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অপরাধ প্রতিরোধে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭, ১০৮, ১০৯ ইত্যাদি ধারায় অপরাধীর কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ
নারীকে সম্মান করার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন জারি করা প্রয়োজন। নারীর সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে প্রচারণা করতে হবে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯-এ নারী সহকর্মীর প্রতি পুরুষের আচরণ যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সারা দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে অনুরূপ প্রচারণার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয় জনপ্রচারণার অঙ্গীভূত করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ
বয়স নির্বিশেষে নারীকে শৈশব থেকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা যে শাস্তিযোগ্য, অভিযোগ দায়ের তথা তা প্রতিহত করার পদ্ধতি সম্পর্কে তাকে সচেতন করতে হবে। নারী অধিকার সংস্থা ও সরকারি আইন সহায়তা কেন্দ্রের সুযোগ গ্রহণের বিষয়ে তাকে অবহিত করতে হবে। সহিংসতার শিকার নারীকে সহায়তার সুযোগ প্রসার করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংস আচরণকারীদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রাপ্যতাহীনের তালিকাভুক্ত করতে হবে। সব সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে এই প্রচারণায় সহায়তার অনুরোধ করতে হবে।