ভাব বিনিময়ের মাধ্যম থেকে আদর্শ রচনার বাতিঘর

বাবুল চন্দ্র সূত্রধর
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:১৬

‘গণতান্ত্রিক সংবাদপত্র হচ্ছে এবং হওয়া উচিত জনগণের এবং একমাত্র জনগণের। সবচেয়ে আবেগপূর্ণ চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ এবং এর সকল আশা-নিরাশা, ভালোবাসা, ঘৃণা, আনন্দ-বেদনার সমব্যথী’- কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, সংগৃহীত রচনাবলি, খণ্ড-১, পৃ. ৩১১-১২।
আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মানুষের জীবনের সব কর্মকাণ্ডই গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। একটি দিনও যেন গণমাধ্যম ছাড়া চলে না। মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সব দিককে সুষমামণ্ডিত করার তথ্য সরবরাহের বাহন হিসেবে গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়েছিল; অবশ্য যুগে যুগে বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম আজকের অবস্থায় উন্নীত।
গণমাধ্যমের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস ঘাঁটলে এর তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়; প্রথম স্তর বা সূচনাপর্বে ভাবের প্রকাশ ও বিনিময়, দ্বিতীয় স্তর বা বিকশিত পর্বে মত প্রকাশ, যা সুনির্দিষ্ট কাঠামোতে রূপান্তরিত হয় ও তৃতীয় স্তর বা চূড়ান্ত পর্বে স্থিতিশীল চেতনা তথা আদর্শ রচনা।
পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমেই মানুষের সভ্যজীবনের সূত্রপাত সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। ভাব বিনিময়ের মূল মাধ্যম ভাষা। ভাষার আবিষ্কারের পূর্বেও মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করেছে সংকেত, ইশারা-ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গি প্রভৃতির মাধ্যমে। ভাষা ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ভাবের প্রকাশে আনে নবতর রূপ-মূর্ত অবয়ব। ক্রমে তা মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আজ গণমাধ্যম ব্যক্তি, গোষ্ঠী এমনকি জাতির আদর্শ রচনার কার্যকর বাহনরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
বাকস্বাধীনতা তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে (মৌলিক অধিকার) অন্যতম উপাদান হিসেবে সংযোজন করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ নং ধারা (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা) বলা হয়েছে : ৩৯ (১)। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। ৩৯ (২)। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি ও অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
মোট কথা, কতিপয় সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত দেশের যেকোনো নাগরিক তার মনের ভাব প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। যেসব ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজনও তো নেই। দেশের গণমাধ্যমগুলো এই অধিকার থেকেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের আদর্শিক চেতনা যাই থাকুক না কেন, সংবিধানে বর্ণিত আইনকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই।
গণমাধ্যম নির্ভরশীলতা বলে সামাজিক বিজ্ঞানের উন্নয়ন অধ্যয়নসংশ্লিষ্ট শাখাগুলো বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, যদিও আজকাল বিষয়টি অনেকটা ম্রিয়িমাণ হয়ে পড়েছে। এটি আর কিছু নয়, সাহায্যদাতা উপাধিধারী উন্নত দেশগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে এমন কিছু তথ্য সুকৌশলে প্রকাশ করত, যার প্রভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দাতাগোষ্ঠীর দ্বারস্থ হতে হতো এবং তাদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নতুনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে বাধ্য হতো। এর ব্যত্যয় ঘটানোর ফলে অনেক দেশের কর্ণধারদের দুঃখজনক পরিণতির ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় কম নেই।
একটি সহজ ও জানা বিষয় তুলে ধরি : জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারী উন্নত দেশগুলো তাদের ওষুধের পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিত দরিদ্র দেশগুলোকে। ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা এটিকে নিজের দেশে বিতরণ করত অথবা করত না। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা গণমাধ্যমে সুচতুর প্রচারণা চালাত, যাতে দরিদ্র দেশগুলোকে আকৃষ্ট করা যায়।
বর্তমানে গণমাধ্যম ছাড়াও মত প্রকাশের অনেক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত মাধ্যমটি তন্মধ্যে অন্যতম। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টিকটক প্রভৃতি ভাব প্রকাশক উপাদান অনেকের তথ্যের ক্ষুধা নিবারণ করে থাকে। তবে বিশেষভাবে বলা আবশ্যক যে, বর্ণিত মাধ্যমগুলোর পরিবেশিত তথ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি। এগুলোকে মানুষ ধরে নিয়েছে নিছক সময় কাটানোর বাহনরূপে কিংবা বড়জোর সাময়িক আনন্দ লাভের জন্য।
এখন একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী লোকজনও কোনো সংবাদ শুনলে পালটা প্রশ্ন করে বসে, এটি কোথা থেকে শুনেছ বা পেয়েছ? সংবাদের সূত্র শুনেই মানুষ বুঝে ফেলে এটি কতটুকু নির্ভরযোগ্যতা রাখে। এমনকি আমি নিজে এও শুনেছি যে, দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত একটি সংবাদ একজন অন্যজনের কাছে জানালে উত্তর আসে, সংবাদটি ইউটিউব না ফেসবুকের? অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত সংবাদমাধ্যম তথা পত্রিকা বা বেতার-টেলিভিশনের সংবাদ ছাড়া কেউ এখন আর সংবাদে বিশ্বাস রাখতে চায় না।
প্রসঙ্গত বলতে চাই, নির্মল বিনোদনের বাহন এক বিষয় আর তথ্য উপস্থাপন আরেক বিষয়। তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কীভাবে এসব মাধ্যমকে দায়িত্বশীল করে তোলা যায়, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গভীরভাবে ভাববার প্রয়োজন একেবারেই জরুরি হয়ে পড়েছে। এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বোধ হয় কোনো তথ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গণমাধ্যম বিশেষ করে পত্রপত্রিকা ও বেতারের অবদান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের পূর্ব থেকে বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) পত্রপত্রিকা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে নানাভাবে প্রচারণা শুরু করে; পাকিস্তানি শাসকদের শোষণপ্রক্রিয়া ও এর ফলাফল জনগণের কাছে তুলে ধরে। সংবাদপত্রগুলোর এহেন সদর্থক অবস্থান শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে পালন করে এক অনন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা। নিরস্ত্র, প্রশিক্ষণবিহীন, অশিক্ষিত ও খেটে খাওয়া বাঙালি জাতিকে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করা সংবাদপত্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠত কি না, তা বিজ্ঞজনই বলতে পারবেন। তবে আমরা বলব, নিজের মহা মূল্যবান জীবন যেখানে তুচ্ছ হয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকার প্রতিটি ধূলিকণার স্বকীয়তা রক্ষার মানসে, সে মানসিকতা কি খুব সহজে গড়ে উঠেছিল? আদর্শ কি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে যায়? স্মরণ করার মতো যে, একসময় বাংলা অঞ্চলের বিশেষ বিশেষ পত্রিকার নামের সঙ্গে ‘গোষ্ঠী’ পদটির সংযোগ ঘটেছিল আদর্শিক চেতনার কারণেই।
আদর্শের এহেন দুর্মূল্য ভিত্তি রোপণের জন্য মহামতি লেনিন সংবাদপত্রকে দেখেছিলেন ‘অর্থনীতির পুনঃ অধ্যয়নের হাতিয়ার’ হিসেবে।