Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

স্বাধীনতা দিবস ও ‘তিরিশ লাখে’র দায়

Icon

রফিকুর রশীদ

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১৪:৩০

স্বাধীনতা দিবস ও ‘তিরিশ লাখে’র দায়

পৃথিবীর প্রায় সকল স্বাধীন দেশেরই আছে মহিমামণ্ডিত স্বাধীনতা দিবস, কিন্তু বিজয় দিবস নামে বিশেষ বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত এবং বিপুল গৌরবমণ্ডিত দিন সব জাতির ইতিহাসে নেই; সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সফলভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনও সব জাতিকে করতে হয়নি। এই পৃথিবীর এক প্রান্তের প্রায় নামহীন পরিচয়হীন বাঙালি জাতি সেই অনন্যসাধারণ কাজটি করেছে বলেই তাদের কাছে বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা স্বাধীনতা দিবসের চেয়ে মোটেই কম কিছু নয়। বরং নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিজয়ের অগ্নিমশালে শুচি হয়েই বাঙালি পেয়েছে অমল ধবল স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সেই মহান স্বাধীনতা দিবস, আমাদের জাতীয় দিবস।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নয়, শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে গৌরবময় বিজয় অর্জন করেছে। অঞ্চলভিত্তিক ছোটখাটো খণ্ড-ক্ষুদ্র যুদ্ধজয়ের দু-চারটি দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও ভাষাভিত্তিক

বাঙালিত্বের পরিচয়ে এবং বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্যবীর্যময় বিজয় লাভ বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। অথচ ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল অসম, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ।

২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অতর্কিতভাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে সারা দেশে চরম ত্রাস সৃষ্টি করে। দুঃসহ এই জীবন-মরণ সংকটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়। যুদ্ধবিমুখ নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সাহসিকতা ও প্রবল দেশপ্রেমের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যের পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়, সার্থক হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ‘স্বাধীনতা’- এই মহার্ঘ অর্জন নিয়ে আমাদের আনন্দ এবং শ্লাঘা পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু বিরাট এই পর্বতের ভিত্তি রচিত হয়েছে যাদের রক্তের মূল্যে, জাতীয়ভাবে তাদের অবদান কীভাবে এবং কতখানি মূল্যায়িত হয়েছে, সেটা খতিয়ে না দেখলেই নয়। 

৫৪ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসান হওয়ার পরিবর্তে জাতীয় অর্থনীতির চরিত্র ও প্রবণতা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বৈষম্যের ফাটল অতি মাত্রায় প্রকট হয়ে উঠেছে বলেই এতদিনে আবারও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছে এবং কবুল করতেই হবে, সে আন্দোলন আজ গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে উদ্যত। এই পাঁচ দশকের বাংলাদেশের অর্জিত সব সাফল্য মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যর্থতার এই প্রশ্নে এসে। আমরা সে আলোচনায় না গিয়ে এই স্বাধীনতা দিবসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই ‘তিরিশ লাখ’ শহীদ প্রসঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধে নানা রকমের অবদানের জন্য এরই মাঝে সরকার নানান স্বীকৃতি, সনদ ও ভাতা প্রদানের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু এ নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়েছে। এটা হয়েছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে। বিগত সরকারের সচিব পর্যায়েও যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সন্নিবেশিত হয়ে যায়, তখন আর এ নিয়ে মন্তব্য করার কিই-বা থাকে! স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি, এর চেয়ে গ্লানির আর কী হতে পারে! পারিনি আরো অনেক কিছুই। আমাদের গীতিকবি বুকের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া গান লিখেছেন ‘দুঃসহ বেদনার কণ্টকপথ বেয়ে শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’ লিখেছেন, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’ তা বেশ, তাদের ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না, শোধ হওয়ারও নয়। কিন্তু প্রশ্নটা এখানে- তারা সত্যিই কতজন ছিলেন? এক-দুই-তিন-চার করে কাঁটায় কাঁটায় ঠিকঠাক সঠিক সংখ্যা না হয় না-ই হলো, কী তাদের নাম-ঠিকানা সেইটুকুও কোথাও লেখা হবে না!

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যারা শহীদ হয়েছেন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাও অবিতর্কিত নয়) অথবা অমুক্তিযোদ্ধা শহীদ (সাধারণ মানুষ) যা-ই হন না কেন, সেই শহীদের তালিকাও নেই আমাদের হাতে। বলা হয় তিরিশ লাখ শহীদের কথা। এই সংখ্যা নিয়েও অভব্য ও অরুচিকর বিতর্ক তৈরির চেষ্টা এ দেশে হয়েছে এবং তার অবসান হয়নি। এ বিতর্ক যেকোনো প্রকার সৎ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা এই ‘তিরিশ লাখের’ প্রাকারবন্দি হতভাগ্য (!) মানুষগুলোর কোনো পরিচয় জাতি জানতে পারবে না কখনো? শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তবু এক প্রকার তালিকা পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যেসব সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তাদের কি কোনো দিন কোনো রকম তালিকাই হবে না? খাস জমি কিংবা সরকারি ভাতা না হোক বরাদ্দ তাদের নামে, তবু শহীদের স্বীকৃতিটুকু অন্তত দেওয়া যাবে না? কারো উত্তরপুরুষ যদি জাতির কাছে জানতে চায়- আমার পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালে তার নিজ বাড়িতেই পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, তবু তাকে শহীদ বলা হবে না কেন? রাষ্ট্রের কোনো দলিলপত্রে তাকে শহীদ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কেন? তার এই প্রাণদানের কোনো মর্যাদা নেই? কেবল ‘তিরিশ লাখে’র প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলেই চলবে?

আমরা কিছুতেই ভুলে যাব না যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দুই দল সৈনিকের শক্তি পরীক্ষার যুদ্ধ ছিল না, একেবারে শুরু থেকেই অগণিত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে তা হয়ে উঠে জনযুদ্ধ। সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তৈরি করা যত সহজ, মনে রাখতে হবে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ মোটেই তত সহজ নয়। প্রয়োজন আন্তরিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ। এ ধরনের শুভ উদ্যোগের জন্য জাতিকে আর কত অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! 

শোনা যায়, ‘তিরিশ লাখ’ এই সংখ্যা নিয়েও কোনো কোনো মহলে বিশেষ উদ্বেগ আর শঙ্কা রয়েছে, পাছে শহীদের সংখ্যা যদি ওই পরিমাণ না হয়! সত্যের ভার বহনে লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই। সংখ্যা যদি তিরিশ লাখের ওপরে হয়, সেটা কি তবে আনন্দের হবে? আমার তো মনে হয়, এমনকি প্রবলভাবে বিশ্বাস হয়- এখনো নিরপেক্ষভাবে গ্রামে গ্রামে সরেজমিনে দল নামিয়ে হিসাব নিতে পারলে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখেরও অধিক হবে।

তিরিশ লাখের প্রাকার ভেঙে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা ও সঠিক পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। শহীদের সংখ্যাগত বিতর্কের বাতি উসকে দেওয়ার বদমতলব থেকে এ নিবন্ধ রচনা করা হয়নি, বরং মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধা নির্বিশেষে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সব শহীদের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানোর তাগিদ থেকেই এই কথাগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। 

শহীদদের সঠিক নাম-পরিচয় উদ্ধার শুধু নয়, স্থানীয়ভাবে তাদের নামে বিভিন্ন প্রকার স্মারক নির্মাণ, স্কুল-কলেজ ও সড়ক-সেতুর নামকরণের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। শহীদের উত্তর প্রজন্ম এই নামকরণের মধ্যেও দেশের প্রতি তাদের পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও স্বস্তি খুঁজে পাবে। এটুকু করার জন্য শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো দাবি উত্থাপন করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি, হয়তো কোনো দিন এ দাবি তারা করবেনও না; এটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরই কর্তব্য। যাদের প্রাণের মূল্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়, আমরা পেয়েছি বহু প্রত্যাশিত ও প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা, তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর দায় আমাদের সবারই। কাজেই দেশপ্রেমিক সব মানুষকেই আজ শহীদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের এই দাবি তুলতে হবে এবং  সরকারেরও যথাযথ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।

শহীদের সংখ্যার পাশাপাশি যুদ্ধকালে সম্ভ্রমহারা নারীদেরও সঠিক সংখ্যা ও পরিচয় উদ্ধার করা জরুরি। কাজী নজরুল ইসলাম ‘কোন রণে কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর’ বলে স্বামীহারা অকাল বিধবাদের সংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে খেদোক্তি জানিয়েছেন যে শহীদদের নামের পাশে তাদের নাম কখনো লেখা হয় না। আমরা আর একধাপ এগিয়ে শহীদপত্নদের নাম ছাড়িয়ে সম্ভ্রমহারা বীরাঙ্গনাদের কথাও বলতে চাই। তাদের প্রতি সম্মান জানানোর মহৎ উদ্দেশ্যেই তাদের নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। সত্যিকারের ইতিহাসের প্রতি দায়বোধ থেকে বলতেই হয় বিলম্বে হলেও এই কঠিন কাজে হাত দেওয়াও খুব জরুরি।

আরো জরুরি প্রয়োজন গণমানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণে ধন্য আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল কারা? অনেকে এরই মধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেছে। তবু এখনো আন্তরিকতা নিয়ে কাজে হাত দিলে এই কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকাও প্রস্তুত করা সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন পরে কী হবে এ তালিকা করে? সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলাও এক রকম পাপ, এক রকম অন্যায়। এ পাপের বোঝা আর কতকাল বয়ে বেড়াব আমরা?

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আসুন আমরা আমাদের এতদিনের অপারগতাগুলোর বিশ্লেষণ করি সাদা চোখে নিরপেক্ষভাবে। আর কিছু না পারি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করার পক্ষে জোর দাবি তুলি এবং তাদের ‘তিরিশ লাখে’র সংখ্যাগত প্রাকারের বাইরে বের করে আনি। নইলে ‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা’র প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হবে না।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫