
গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। বারোশ শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপে মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ছিল তারা যাযাবর যোদ্ধা, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ও নৃশংস কৌশলে পারদর্শী। তাদের নৃশংসতা নিয়ে মানুষের মুখে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মঙ্গোলরা এক রাজ্যের রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে তার থেকে কর হিসেবে শস্য ও সম্পদ দাবি করে। তখন রাজা বলে, ‘এই রাজ্যে ১০ লাখ লোক থাকে, আপনি যত সম্পদ দাবি করছেন, তা নিয়ে গেলে আমার ছয় লাখ লোক খাদ্য অভাবে পড়বে।’ এ কথা শুনে মঙ্গোল সেনাপতি তখনই রাজ্যসভা ত্যাগ করলেন। এবং পনেরো দিন পর আবার রাজ্যসভায় ফিরে এলেন। সেনাপতি রাজাকে বললেন, ‘আমাদের কর আমাদের দেন, আপনার রাজ্যে খাদ্যের অভাব হবে না। আমরা গত ১৫ দিনে ছয় লাখ লোককে হত্যা করেছি।’
ইতিহাসে পরবর্তী সময়ে আরো অনেক গণহত্যার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর্মেনিয়ান গণহত্যা, যেখানে ১৯১৫ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্য, প্রায় ১২ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ইহুদি গণহত্যা যেখানে ১৯৪১-১৯৪৫ সময়ে জার্মান সেনাবাহিনী প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। তুতসি জাতিগোষ্ঠীর গণহত্যা যেখানে রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে ১০০ দিনে প্রায় আট লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০০৩ সালে সুদানের দারফুর অঞ্চলে জানজাউইদ, সুদানের সেনাবাহিনী ও উপসামরিক দল পপুলার ডিফেন্স ফোর্স মিলে প্রায় চার লাখ মানুষ হত্যা করে এবং এতে ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এসব ক্ষেত্রে একটা মিল দেখা যায় যেকোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে নির্বিচারে নিধন করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে গণহত্যার বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরির চেষ্টায় জাতিসংঘ ২০১৫ সাল থেকে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে ২৫ মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিবসের সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে মিলিটারি শাসনের অবসান ঘটাতে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দমন-নিপীড়নের পদ্ধতি গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং জেনারেল নিয়াজীর বাসভবনে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেখানে জেনারেল নিয়াজী বলেন, ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে যখন সাধারণ নির্বাচনের প্রাথমিক আলোচনা চলছিল, তখন মেজর জেনারেল ইয়াকুব আলী খান ‘অপারেশন ব্লিতজ’ নামের একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল যদি নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কোনো সমাধান না হয় তবেই তা বাস্তবায়ন করা হবে। বাঙালি জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭১ সালে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার গঠনের সব সমাধান ব্যর্থ হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিচালনা করা হয়। কালরাত্রির এই পরিকল্পনায় পুরো বাংলাদেশকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয়। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রাজশাহী ও রংপুরের দায়িত্ব নেয়। রাত ১১টা ৩০ মিনিটে সেনানিবাস থেকে ট্রুপস বের হয়। রাত ১টা নাগাদ ধানমন্ডির বাসা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসের গার্লস স্কুলের একটা কক্ষে এনে রাখা হয়। দিনের বেলা এই কক্ষে থাকতেন এবং রাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বাসায় থাকতেন, এভাবে এপ্রিলের ১ তারিখে তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাতের একই সময় আক্রমণ করা হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও পুরান ঢাকা। একই সময়ে দেশের সব সেনানিবাসে বাঙালি সিপাহি ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা হয় এবং সব অস্ত্রাগার, রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়। ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের মতে, এই গণহত্যায় অংশ নেয় প্রায় ৩৮ হাজার সদস্য, যার মধ্যে ছিল সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও সহযোগী সদস্য।
ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন জন ড্রিং ৩১ মার্চ ১৯৭১ সালে পত্রিকায় প্রকাশ করেন যে এই এক রাতে সাত হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। যার মধ্যে ছিল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পুলিশ, সেনা ও সাধারণ জনতা। এই গণহত্যা এখানেই শেষ হয়নি। বরং তা চলমান ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। এই সময়ে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
পৃথিবীতে গণহত্যা এখনো চলমান। নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছেই। এসব গণহত্যা কখনই মানবজাতির জন্য শান্তি বয়ে আনতে পারেনি। ১৯৭১ সালে কাইফি আজমি তার লেখা কবিতায় বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন : ‘আমি একটা দেশ নই, যে তুমি আমাকে জ্বালিয়ে তছনছ করে দিবে, আমি একটা দেয়াল নই, যে আমাকে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুড়ো করে দেবে, একটা সীমান্ত রেখা-তাও নই, যে আমাকে মুছে ফেলে দেবে’।