Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আঁধারে অতল তাদের সোনালি ভবিষ্যৎ

Icon

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২০ মে ২০২০, ১৪:৪৬

আঁধারে অতল তাদের সোনালি ভবিষ্যৎ

‘আজ যে শিশু/পৃথিবীর আলোয় এসেছে/আমরা তার তরে/একটি সাজানো বাগান চাই/আজ যে শিশু/মায়ের হাসিতে হেসেছে/আমরা চিরদিন/সেই হাসি দেখতে চাই...’ রেনেসাঁর গাওয়া গানটিকে ইদানীং মিথ্যা বলেই মনে হয়। আমরা কি সত্যিই চাই প্রতিটি শিশু মানুষ হোক আলোর ঝর্ণাধারায়, ওদের আনন্দমেলায় স্বর্গ নেমে আসুক, হাসি আর গানে ভরে যাক সব শিশুর অন্তর?

তাই যদি হবে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কেন বেড়েই চলেছে। কেন তাদের দিয়ে ভারী কাজ করানো হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে কর্মে নিয়োজিত দেশের লাখ লাখ শিশুর নীরব কান্না কেন কেউ শুনতে পায় না। ওদের ওপর আজও কেন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন? অথচ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় শিশুনীতিও। শিশুশ্রম নিরোধে রয়েছে আইন। এসব যেন ‘কাজির গরু কেতাবে’ থাকার মতো।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটিরও বেশি। ৯০ শতাংশ প্রাথমিকভাবে স্কুলে গেলেও শিক্ষা শেষ করার আগেই অর্ধেকের বেশি ঝরে পড়ে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ শিশু শ্রম দিচ্ছে কেবল খাদ্যের বিনিময়ে। আবার ২৩.৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেওয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে শিশু শ্রম নিয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে তাও রীতিমতো ভয়াবহ। জানা যায়, দেশে প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জনই শিশু শ্রমের আওতাধীন। এর প্রায় ৭৫.৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫ শিশুই নিয়োজিত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।


বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং ২০১৩ (সংশোধিত) অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে, তা অনুমোদনযোগ্য। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, সেটা শিশু শ্রম। বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। যার মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারও এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৩৮ ধরনের কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। যেমন- ট্যানারিশিল্প, গ্যাস ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন কিংবা ওয়েল্ডিং, অটোমোবাইল কারখানা, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক কারখানা, লবণ কারখানা, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, ইটের ভাটা, পরিবহন খাত, আবর্জনা সংগ্রহ, কাঠমিস্ত্রি, জুয়েলারি শিল্পের কারিগর, চাল ও মসলার কারখানা, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানায় কাজ এবং মাদকদ্রব্য বিক্রি।

চার দেয়ালে বন্দিজীবন

১০ কিংবা ১১ বছরের শিশু আসমা খাতুন। কেউই অবশ্য এ নামে আর ডাকে না। ‘দুঃখিনী’ বলে হাক দিলেই সাড়া দেয় সে। পরিবারের লোকজনই তাকে এ নামে ডাকত। ছোটবেলায় বাবা মারা যায়। মা আবার বিয়ে করায় তার ঠাঁই হচ্ছিল না ছোট্ট সেই ঘরে। তাই আত্মীয়ের মাধ্যমে সে চলে আসে রাজধানীতে। এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজও জুটে যায়। কিন্তু দুঃখ ছেড়ে যায়নি দুঃখিনীর জীবন থেকে। বাসার ছোটা বুয়াটাও কদিন ধরে আর আসে না। এক সময় সে বুঝতে পারে তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। ছোট্ট দুটি হাতেই সামাল দিতে হয় বিশাল বাসার পুরো কাজ।

আসমা ভাবতো, হাতের কাজগুলো শেষ করলেই হয়তো একটু বিশ্রাম মিলবে। তখন টিভি দেখা যাবে মন ভরে। তা আর হয় না কখনোই, ডাক পড়ে নতুন কোনো কাজের জন্য। কোনো কিছুতে না বলতে আগেই মানা করে দিয়েছেন ম্যাডাম, তাই যখন যে কাজ দেওয়া হতো মাথা পেতে তা করে ফেলত আসমা। এর পরও পান থেকে চুন খসলেই চলতো নানা ধরনের নির্যাতন। মুখ বুজে সব সহ্য করা ছাড়া তার যে আর কোনো উপায়ও নেই। প্রতিনিয়তই এমন দুঃখিনীর গল্প রচনা হচ্ছে ঢাকার অনেক ফ্ল্যাটেই। তাদেরকে কেউ এসে বলেও না- ‘চেয়ে দেখো উঠেছে নতুন সূর্য/পথে পথে রাজপথে চেয়ে দেখো/রংয়ের খেলা/ঘরে বসে থেকে লাভ কী বলো/এসো চুল খুলে পথে নামি,/এসো উল্লাস করি/দুঃখিনী দুঃখ করো না,/দুঃখিনী দুঃখিনী...।’

ধানমন্ডির গৃহিণী নুসরাতের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘বড়দের রাখলে চুরি করে পালিয়ে যায়। পাশাপাশি নানা ঝুটঝামেলাও থাকে ওদের নিয়ে। কিন্তু কম বয়সী বাচ্চাদের নিজের মতো করে রাখা যায়। আমাদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেও সহজেই মিশে যেতে পারে। আবার দেশে অজস্র গার্মেন্টস কারখানা তৈরি হওয়ার পর থেকে কাজের মানুষ এখন পাওয়াই যায় না। তাই বাধ্য হয়েই কম বয়সী শিশুদের রাখতে হয়, এ ছাড়া তো উপায় নেই। তবে ওদের সঙ্গে আমরা কোনো খারাপ আচারণ করি না। পড়ার জন্য বইও কিনে দিয়েছি।’

শিশুদের জন্য গৃহশ্রমকেও এখন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার দাবি তুলছে শিশু-অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সাবেক চেয়ারপারসন ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘শিশু শ্রম প্রতিরোধে প্রধান বাধা দরিদ্রতা। শুধু দারিদ্র্যের কারণেই দেশের লাখো শিশু নিয়োজিত হচ্ছে গৃহকর্মী হিসেবে। গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে অনেকে নির্যাতিত হলেও, এ কাজে শ্রম দেয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়নি। একে তো তারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং বিত্তহীন শ্রেণির মানুষ। তাদের পক্ষে কথা বলার মতো যেমন কেউ নেই; তেমনি আইন যা আছে, যতটুকু আছে, তারও কোনো প্রয়োগ নেই। এরা এতকিছু জানেও না।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘গৃহশ্রমে যারা রয়েছে, তাদের সঠিক পরিসংখ্যান আজও হয়নি। কেউ চার লাখ, কেউ আবার দাবি করে ৪০ লাখ। তাই জাতীয়ভাবে এর একটা পরিসংখ্যান থাকা খুব জরুরি। কেননা, নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও এখন অনেকে মনে করেন শিশুরা কাজ করবে- এটাই সহজাত। আবার যারা নিয়োগকর্তা রয়েছেন তারাও মনে করেন, আমরা কাজ দিয়ে ওদের জীবন বাঁচিয়েছি। কিন্তু তাদের শারীরিক, মানসিক, দৈহিক বা স্পিরিচুয়াল গ্রোথ যে ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, শিশুদের মারধর করছে, বকা দিচ্ছে, যৌন নির্যাতন করছে, আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্ট (অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ) হলে বের করে দিচ্ছে- এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।’ 

অকাল মৃত্যুর হাতছানি 

দেশের চামড়া শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের একটা বড় অংশই শিশু। কাজের সময় তারা গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করে না। অনেক সময় হাত না ধুয়েই কাজের ফাঁকে খাবার খায়। তাই তাদের বেশিরভাগেরই শ্বাসকষ্ট ও খোসপাঁচড়া রোগ হয়। কখনো ক্যান্সারও বাসা বাঁধে জীর্ণ শরীরে, যা অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ট্যানারিতে এসব শিশুকে কাজে লাগানোর নেপথ্যে রয়েছে মূলত দালালচক্র। পথশিশু, দরিদ্র শিশু, এমনকি দরিদ্র এতিমদের টার্গেট করে এখানে নিয়ে আসে তারা। কোরবানি ঈদের সময় চামড়া ব্যবসা যখন তুঙ্গে, তখন শিশু শ্রমিকদেরও ভিড় জমে। তাদের কেউ বলছে, ‘বাবা-মা থেকেও নেই, তারা আমাদের খোঁজ নেয় না।’ কেউ বলছে, ‘বাবার কোনো রোজগার নেই কিংবা নেশা করে, তাই আমি কাজ করে সব টাকা মাকে দিই।’ কেউ আবার বলছে, ‘যেদিন মজুরি পাই না, সেদিন আমরা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।’ 

ট্যানারিগুলোতে পচা চামড়ার গন্ধে যেখানে টেকা দায়, সেখানে দিব্যি কাজ করে চলেছে শিশুরা। এতে কোনো সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে এক শিশু শ্রমিক জানায়, প্রথম একটু খারাপ লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখানে কাজ করা প্রায় শিশুদের হাত-পা এবং কোমরে ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন। আর সেই ক্ষত বেয়ে অনবরত পড়তে থাকে রক্ত, পুঁজ। জানতে চাইলে নিপুণ নামে এক শিশু বলল, ‘চুলকাইতে চুলকাইতে এমন হয়েছে। লবণের কারণে হাত-পাগুলো ছিদ্র ছিদ্র হয়ে গেছে।’

চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহৃত সালফিউরিক এসিড, ক্রোমিয়াম এবং সীসা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তার ওপর এসব কারখানায় নেই কোনো বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা কিংবা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক গবেষণায় জানা যায়, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই ট্যানারিতে শ্রমিকরা যেভাবে খালি গায়ে ও খালি হাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, তাতে এ রাসায়নিকের প্রভাবে তাদের ফুসফুস ও চামড়ায় ক্যানসার হতে পারে। এছাড়াও দেখা দিতে পারে নানা ধরনের চর্মরোগ।

শিশু শ্রমিক রাখার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারখানার মালিক বলেন, ‘শিশু শ্রম নিষেধ করছে সরকার ঠিক আছে। তয় সরকার তো আর ওদের খাওন-পরনের লাগি টাকা দেয় না। এখানে যেসব শিশু কাজ করে, তাদের বেশির ভাগ পরিবারই তিন বেলা খাইতে পারে না। ওইসব পরিবারের লোকজন আমাগো কাছে আইসা কান্দে। তাই মায়া লাগে, কাজে রাখতে বাধ্য হই। এদেরকে ছোটবেলা থেইক্কাই তো আমরা বড় করি। কাম শিখাই। তাছাড়া বয়স্করা টাকা-পয়সা নিয়া বেশি দরকষাকষি করে। অনেক সময় ঝামেলাও পাকায়। কিন্তু ছোট পোলাপাইনরে দিয়া কাজ করানো নিরাপদ।’

মৃত্যুকূপে মলিন জীবন

নকল কেমিক্যালের গুদাম ও কারখানায় ছড়াছড়ি পুরান ঢাকার অলিগলি। নানা রকমের দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করায় বাড়িগুলো যেন একেকটি ‘মৃত্যুকূপ’। বিপজ্জনক দাহ্য কেমিক্যালের ব্যবহার করছে অপেশাদাররা। অতিদাহ্য কেমিক্যালের মধ্যে রয়েছে- পটাশিয়াম ক্লোরেট, পটাশিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট, নাইট্রোসেলুলোজ, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, টলুইন, জাইলিন, এসিট্রন, রেড ফসফরাস, সালফার, আইসো প্রোফাইল অ্যালকোহল, থিনার, সলিউশন, কেলিটন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্যারানল, মিথানল, ডি-এলেথ্রিন ইত্যাদি। আর পটকা এবং আতশবাজির কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে গানপাউডার।

আর এসব কারখানায় অধিকাংশ শ্রমিকই শিশু, যাদের কেমিক্যাল সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই। কোনো সুরক্ষা ছাড়াই তারা এসব দিয়ে তৈরি করছে নকল কসমেটিকস, সুগন্ধি ও আতর, ড্রাইসেল ও ব্যাটারি, সলিউশন, আতশবাজি ও পটকা, বৈদ্যুতিক তার, জুতা ও ব্যাগ, নিষিদ্ধ পলিথিন, ব্লিচিং পাউডার, ওয়াশিং পাউডার, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, রাবার, কয়েল, রংসহ বিভিন্ন পণ্য। 

রাজধানীর চকবাজারকে ঘিরে নকল পণ্য তৈরির কারখানা রয়েছে অসংখ্য। কোনোটিতেই সাইনবোর্ড নেই। কোনো ভবনের গেটে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। এমন একটি বাড়ির নিচতলায় ঢুকে দেখা যায়, আলো জ্বলছে নিভু নিভু। স্যাতস্যাতে পরিবেশ। আট থেকে ১২ বছরের বেশ কয়েকজন শিশু কয়েল তৈরির কাজে ব্যস্ত। পাশেই পড়ে আছে লিজার্ড, অ্যাকশন, ম্যাক ফাইটার, পরিমা, দাদাগিরী, রয়েল কিং নামে কয়েকটি কোম্পানির মোড়ক। প্রতিটি প্যাকেটের গায়েই ‘বিএসটিআই’-এর সিল। অথচ কারখানাটিরই কোনো অনুমোদন নেই। শিশু শ্রমিকদের দিয়ে মাত্রারিক্ত বিষাক্ত ডি-এলেথ্রিন মিশিয়ে তৈরি হয় এসব নিম্নমানের কয়েল।

পরে তা বিভিন্ন মোড়কে ভরে বাজারে ছাড়া হয়, যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিষ্ঠানের মালিক সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউই মুখ খুলেনি। শিশুদের দিয়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও দ্রব্য মিশিয়ে কয়েল তৈরির বিষয়েও কোনো কথা বলতে রাজি হননি কারখানা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রবিউল। সেখানে কথা হয় শিশু শ্রমিক রাজনের সঙ্গে। তার বাড়ি চাঁদপুর। মাকে ছেড়ে চলে গেছেন বাবা। মাও তাকে ফেলে আরেকজনের সঙ্গে চলে গেছেন। নানির কাছে বড় হয়েছে সে। অভাবের সংসার, খেয়েপরে বাঁচতেই এ কারখানায় কাজ নিয়েছে বছর আটের রাজন। তবে এ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রায় সময়ই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু রাজনই নয়, এ অবস্থা প্রায় সব শ্রমিকেরই।

শৈশবেই দক্ষ ‘ইঞ্জিনিয়ার’ তারা

রাজধানীর অলি-গলিতে তাকালেই চোখে পড়ে ওয়েল্ডিং-ওয়ার্কশপে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুরা। অনেকে আবার লেদ মেশিনও চালায়। পুরান ঢাকার ধোলাইখালের যন্ত্রাংশ তৈরি ও গাড়ি মেরামতের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের প্রায় ২০ শতাংশই শিশু-কিশোর। এটা নাকি কেবল তাদের কাজ শেখার বয়স! তাই মালিকরা শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই করে, কোনো বেতন নেই। তাদেরই একজন রাসেল (১০)। এ বয়সেই কাজে বেশ হাত পাকিয়েছে। কারখানার সবাই আদর করে তাকে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বলে ডাকে। মালিকের খুব বিশ্বস্ত বলে দোকানের চাবি তার হাতেই। প্রতিদিন সকাল ৭টায় শনির আখড়া থেকে রওনা হয় রাসেল, ৮টার মধ্যে দোকান খুলতে হয়। কাজ চলে রাত ১১ থেকে ১২টা পর্যন্ত। কখনো আবার বেশি কাজ থাকলে সারারাতও চলে।

পারিশ্রমিক মিলে সপ্তাহে সাড়ে তিনশ টাকা। আর ওভারটাইম হিসেবে প্রতিদিন ২০ টাকা দেওয়া হয় নাস্তা বাবদ। বাবা মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাই সংসারের খরচের জন্য রোজগারের পুরোটাই তুলে দিতে হয় মায়ের হাতে। তবে রাসেলের স্বপ্ন, ওয়ার্কশপে কাজ শিখে একসময় ওস্তাদ হবে সে। তখন আর কষ্ট থাকবে না। বেশি টাকা মজুরি পাবে। মাকেও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেবে না।

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনেই বেশ কিছু ওয়ার্কশপ। ট্রাক, বাস, লেগুনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ও সিলিন্ডার মেরামত করা হয় এগুলোতে। একটি ওয়ার্কশপে ট্রাকের বডিতে বৈদ্যুতিক ঝালাইয়ের কাজ করছিল নয় বছরের শিশু রবিন। কোনোদিকে দেখার ফুরসত নেই তার। পাশেই আরেকটি গাড়িতে কাজ করছে বড় ভাই ইমরান (১১)। তবে তাদের নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তা। খালি হাতে, খালি পায়ে, নিরাপত্তা চশমা ছাড়াই চরম এই ঝুঁকির কাজ করে এসব শিশু। সকাল থেকে রাত অবদি ওস্তাদের কথা মতো সমানতালে ওয়েল্ডিং, পুরাতন লোহা কাটা ও গলানো, গাড়ির বডি মেরামত, সরঞ্জাম তৈরি করছে। কাজ শেখানোর স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের অধিকাংশকেই পেটে-ভাতে শ্রমে লাগানো হয়। হাতের কাজ শেষ হলে রবিন জানায়, তারা তিন ভাই। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের পক্ষে কোনোভাবেই বাসা ভাড়া ও ভরণ-পোষণে টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথমে ইমরান, কিছুদিন পর তার হাত ধরে একই পেশায় আসে রবিন। কাজের কারণে আর স্কুলে যাওয়া হয় না। তবে ছোট ভাইকে পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা আছে বলে জানায় সে।

অন্য শিশু শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম অবস্থায় কাজে এলে তাদের দুই বেলা খাবার ও নাস্তার খরচ দেওয়া হয়। গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে কিছু বকশিসও মিলে কখনো-সখনো। পরের ধাপে দুপুরের খাবার ও সপ্তাহে ৩০০ টাকা, কিছুটা দক্ষ হলে খাওয়াসহ সপ্তাহে ৫০০ থেকে হাজার এবং পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন করলে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি দেওয়া হয়। তবে এ কাজে অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। দীর্ঘদিন জড়িত থাকায় শিশুদের শ্বাসনালীর সংক্রমণ, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, ফুসফুসে পানিজমা ও কাঁশি, শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কমাসহ শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দেয়।

তবে এক গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘অভাবের কারণে এসব শিশুদের কাজে পাঠান অভিভাবকরা। প্রতি সপ্তাহে বেতনের পাশাপাশি ওরা বকশিশও পায়, তা দিয়ে নিজে চলে এবং পরিবারকে দেয়।’ যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এআই মাহবুব উদ্দিন খান বলেন, ‘কম পারিশ্রমিক দেওয়ার উদ্দেশ্যেই শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। পরিবারে অভাব-অনটনসহ বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যার কারণে শিশুরাও স্বল্প মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে আগ্রহ দেখায়। আবার কাজ করতে গিয়ে বেশিরভাগই বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়। তারা প্রতিবাদও করে না তেমন।’ 

পা পিছলে গেলেই ‘আলুর দম’

‘কালশী, মিরপুর, গাবতলী, হেমায়েতপুর...; সিট খালি সিট খালি...।’ এভাবেই যাত্রীদের ডাকাডাকি করছিল রাজধানীর নতুনবাজারে দাঁড়িয়ে থাকা রাজধানী পরিবহনের হেলপার আল-আমিন। তেল মেখে বাঁ পাশে সিঁথি তুলেছে মাথার চুলে। কাপড়-চোপড়ও মোটামুটি ফিটফাট বয়স দশেকের এ শিশুর। বাস চলতে শুরু করার পর সে দরজা ছেড়ে চলে আসে ভাড়া কাটার জন্য। যাত্রীবেশে কথা হয় তার সঙ্গে। ভাড়া কাটার ফাঁকে বলে, ‘আমাদের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। কিন্তু এখন আর কিচ্ছু নাই, নদীতে সব গেছে। সব হারাইয়া পরিবারের সবাই এখন ঢাকায় চইলা আইছি। বাবায় রিকশা চালায়, আমি বাসের হেলপার। মা আর ছোট দুই ভাই-বোন বাসাতেই থাকে। সকাল থেকে রাইত পর্যন্ত ডাইকা ডাইকা যাত্রীদের বাসে তুলি। ভাড়াও কাটি আমি।’


তবে এ কাজ করতে ভালো লাগে না তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া আল-আমিনের। বই-খাতা এখনো টানে তাকে। ‘পড়ালেখায় ভালোই আছিলাম। স্যারেরা আমারে খুব আদর করতেন। কইতেন- তুই একদিন অনেক বড় হইবি।’ কথার মাঝেই ঝারি দেন বাসচালক, ‘ওই বেটা যাত্রী ডাক।’ স্বপ্ন ঠেলে দরজার কাছে দ্রুত এগিয়ে যায় ছোট্ট শিশুটি। চলন্ত বাসে ঝুলে ঝুলে শুরু করে ডাকাডাকি- ‘ওই কালশী, মিরপুর, গাবতলী, হেমায়েতপুর...।’

১৪ জনের মতো যাত্রী বহনকারী লেগুনা এবং টেম্পু রাজধানীর ফার্মগেট থেকে নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। ছোট্ট বাহনগুলোর হেলপার হিসেবে কাজ করতে দেখা যায় শিশুদেরকেই। অনেক লেগুনায় আবার স্টিয়ারিং হাতে চালকের আসনেও বসছে। ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে চলাচল করেন যাত্রীরা। একদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে লেগুনায় করে ফার্মেগেট ফিরছিলাম। কিছুদূর আসতেই খেয়াল করলাম চালকের সহকারী বছর আটের শিশুটি গাড়ির পেছনে থাকা লোহায় ধরে ঝিমুচ্ছে। হাত ফঁসকে পড়ে যেতে পারে যে কোনো সময়। আমি দ্রুত তাকে টেনে এনে পাশে বসালাম।

কথার প্রসঙ্গে সে জানায়, তার নাম রুবেল। ভোর থেকে কাজ করছে। তাই এখন ঘুম পাচ্ছে। এ ট্রিপটা শেষ করেই ঘরে ফিরবে। থাকে নাখালপাড়া রেলওয়ে বস্তিতে। বাবা মাদকাসক্ত, মা ঝিয়ের কাজ করেন। ছয় মাস আগেও বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যেত শিশুটি। আকাশে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজ দেখে তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু মায়ের আয়ে ঘর ভাড়া, খাবার খরচ চলে না। সে জন্যই বই-খাতা ফেলে কাজে নামতে হয়েছে এ বয়সেই। আর পাইলট নয়, এখন তার একটাই স্বপ্ন- আরেকটু বড় হয়ে লেগুনার চালক হবে। 

শুধু আল-আমিন কিংবা রুবেল নয়, তার মতো প্রায় চার হাজার শিশু এখন ঢাকার পরিবহন খাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সারা দেশে এ সংখ্যাটা কয়েকগুণ। তিন ও চার চাকার টেম্পু ও লেগুনাতেই শিশু শ্রমিক বেশি। তাদের মূল কাজ চালককে সহায়তা ও যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং ভাড়া আদায়। তবে অনেক সময় চালক না থাকলে গাড়ির স্টিয়ারিংও ধরতে হয়। দিনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় তাদের। সঙ্গে দুবেলা খাবার মিলে। বিনিময়ে সবাইকে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা শ্রম দিতে হয়।

তবে অর্ধেকের বেশি শিশু নিজের কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। টেম্পু বা বাসে ঝুলে এ কাজ করায় ধুলোবালি আর ধোঁয়ায় হয়ে পড়ছে অসুস্থ। কখনো কখনো শিকার হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের। বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছে, কেউ কেউ প্রাণটাও হারায় অকালে। কখনো বা কোমলমতি এ শিশুরা আবার মাদকের সঙ্গেও জড়িয়ে যায় খুব সহজেই। ফলে বড় হয়ে অন্যদের প্রতি অসহনশীল আচরণ শুরু করে। তাদের মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটানোর প্রবণতাও বাড়ে। এভাবে এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যাদের আচরণ বা জীবনযাপন সমাজে গ্রহণ করার মতো নয়।

ইটভাটায় পুড়ছে ভবিষ্যৎ

যে বয়সে বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, আনন্দ আর হাসি গানে ভরিয়ে তোলার কথা শৈশবের দিনগুলো; তাদের সেই বয়সটা ইটের ভাটার লেলিহান অনলে পুড়ছে অবিরত। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নয়, পোড়া মাটির গন্ধ শুঁকেই জীবন কাটাতে হয় এই শিশু শ্রমিকদের। আবার নানা অজুহাতে চলে তাদের শ্রম শোষণ। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ন্যায্য মজুরিটাও জোটে না কখনো-সখনো। কোনো কোনো ভাটায় কেবল দুবেলা খাবারের বিনিময়ে ভারি ইট টানানো হয় পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের দিয়ে। দেখার কেউ নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই শিশুরা তাদের শ্রম দিয়ে যায়। মূলত ট্রলিতে করে মাটি বহন, ইট তৈরি, কাঁচা ইট রোদে শুকানো, পরে সেগুলো টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানোসহ সব কাজেই নিয়োজিত এসব শিশু। একসঙ্গে কয়েকটা ইট বহন করতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার কবলেও পড়ে। আহত বা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসারও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।

নেত্রকোনা সদরের নছিবপুর গ্রামের কিশোর হবুল ইসলাম। বছর পাঁচেক আগে তার বৃদ্ধ বাবা এক ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে ছেলের বিনিময়ে ১০ হাজার টাকা দাদন নেন। তাই প্রিয় বইখাতা ফেলে কাজে যোগ দিতে হয় হবুলকে। ভোর হতে না হতেই শুরু হয় ডাকাডাকি। বিকেল পর্যন্ত চলে পরিশ্রম। দুপুরে কেবল খাওয়ার সময়টুকু মেলে। একদিন ইট টানতে গিয়ে মেরুদ-ের মাংশপেশিতে টান লাগে হবুলের। কোনো চিকিৎসা না দিয়ে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় মালিকপক্ষ। কিছুদিন পর উল্টো বাবাকে ডেকে দাদনের টাকা ফেরত চাওয়া হয়। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে যে সবশেষ। উপায় না দেখে ছোট ছেলে আট বছরের খায়রুলকে কাজে পাঠান বাবা। পুরো সংসারের ভার এখন তার ছোট্ট কাঁধে। ইটভাটার সোঁদা ও পোড়া মাটির গন্ধকেই সঙ্গী করতে হয়েছে খায়রুলকে। কথা হয় তার সঙ্গে, ‘ভাই আর কাম করত হারে না। হের চিকিৎসার লাগিন বাড়িডাও বেইচা দিছে আব্বা। অহন মাইনসের জাগাত থাহি। আব্বাও মইরা গেছে বছরখানিক হইছে। হেলল্লাইগ্যা ইটখলাতে (ইটভাটা) অগ্রিম দাদন লই। প্রতিদিন ৮০০ ইট টানি। হেই দিয়াই কোনো রহমে আমরার সংসার চলে।’

কাজ সম্পর্কে এ শিশু জানায়, মাথায় করে শুকনো ইট খোলায় তুলে সে। পোড়া শেষ হলে ইট সাজিয়ে রাখে। কাজটা বড় কষ্টের। অনেক সময়ে ইট মাথা থেকে পড়ে পায়ে ব্যথাও পায়। কিন্তু শ্রমিক সরদার এগুলো দেখেন না। পাশেই বসেছিল বড়ভাই হবুল। ছোটভাইয়ের কষ্টের কথা শুনে চোখের জলকে আড়ালের বৃথা চেষ্টা। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় জানিয়ে সে বললো, ‘মায় যখন আমার ভাইডারে জড়াইয়া ধইরা কান্দে, আমার তহন কলিজায় লাগে। আমার কারণে এত ছোড মানুষটারে এত বড় কাম করতে অয়। নিজেরে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারতেছি না। ভাইডা আমার পড়ালেহায় মেলা ভালা আছিল।’ 

ইটভাটার শ্রমিক মাসুদ মিয়া এক যুগ ধরে এ পেশায়। গায়ের বর্ণও তাই পোড়া ইটের ন্যায়। তিনি জানান, তার মত অনেক পরিবারকে অত্যন্ত নোংড়া পরিবেশে পলিথিনে তৈরি সাড়ি সাড়ি ডেরা ঘরে বসবাস করতে হয়। যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। প্রায় প্রতিটি পরিবারের সঙ্গেই থাকে নানা বয়সের শিশু। তারা শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেক বাবা-মা আবার ভাটার মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নেন। এ টাকা পরিশোধ করতেই অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের শিশু সন্তানরাও বাধ্য হয়ে কাজ করে। কোনো কোনো শিশু ২০ কেজি ওজনের সমান ছয়টা কাঁচা ইট মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।

কয়েকজন ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা শিশুদেরকে দিয়ে কাজ করাই না। আসলে আমাদের ভাটায় যেসব শ্রমিক রয়েছে, তারা বিভিন্ন স্থান থেকে আসা। কেউ কেউ অন্য জেলা থেকে এসে স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করে। তারা তাদের সন্তানদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসে। ওই শিশুরা মূলত তাদের মা-বাবাকে সহযোগিতা করে। এ জন্য আমরা কোনো পারিশ্রমিক দেই না। খাওয়া-দাওয়াটা হয়তো করে আমাদের এখানে।’

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসহ গড় আয়ু কমে যায়। সবমিলিয়ে এ ধরনের শ্রম তাদের সার্বিক ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকির। ডা. মাহাবুব হাসান বাপ্পি বলেন, ‘যন্ত্রের কালো ধোঁয়া, ধুলোবালি, শব্দ ও গরমের কারণে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবার দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া হিসেবে চর্মরোগ, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ নানা রোগের আশঙ্কা থাকে। আবার যাদের আগে থেকে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বা হাঁপানি রয়েছে তাদের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে।’ 

ছোট মাথায় বড় বোঝা

রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে লঞ্চ ভিরলেই চোখে ফিরবে কিছু শিশু-কিশোরের তৎপরতা। যাত্রীদের কাছ থেকে লাগেজ নেওয়ার জন্য তাদের আপ্রাণ চেষ্টা। আকুতির সুরে তাদের অনুরোধ- ‘দ্যান না ব্যাগ খান, পাঁচ-দশ ট্যাহাই দিয়েন নে!’ উশকো খুশকো চুল, মলিন চেহারা, রুগ্ন দেহ, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট কিংবা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এমন শিশুদের দেখা মেলে রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল কিংবা হাট-বাজারেও। দরিদ্রতা তাদের মনোবল এতোই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, ছোট মাথার ওপর বিশাল বোঝা চাপিয়ে অনায়াসেই হেঁটে যায় গন্তব্যে। রাজ্যের পরিশ্রমকে ভেতরেই লুকিয়ে রাখে, পরে যদি কাজ না পায়! ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে লাগেজের পর লাগেজ বহন করেই চলে একমুঠো ভাতের জন্য। এদের কারও বাবা নেই, কারও আবার মা নেই, কারও ঘরে সৎ মা কিংবা বাবা অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন। আবার কারোর বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে হতে হয়েছে কুলি।


সদরঘাটের শিশু কুলি বছর বারোর আকাশ। যাত্রীদের ব্যাগ টেনে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তার মতো শিশু শ্রমিকদের কাজ। কে আগে ছুটে ব্যাগ নিতে পারবে এমন প্রতিযোগিতাই চলে সারাদিন। তবে আকাশ আর আগের মতো দৌড়াতে পারে না। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। চিকিৎসা বলতে কোনো এক ফার্মেসি থেকে ব্যাথার ওষুধ কিনে খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ। আকাশ বলে, ‘ঘরে অভাব, বাপে সংসার চালাইতে পারে না। হের লাইগ্যা এই কাম হরি। ব্যাগ টানতে গিয়া কহনো কহনো মাইনষের চর-থাপ্পরও খাইতে অয়। কেউ আবার ভারি ব্যাগ টানাইয়া ট্যাহা কম দেয়। কী আর করন যাইবো, আমাগো পেট তো বাঁচাইতে অইবো। একদিন কাম না হরলে পেটে ভাত জুটবো না। হারা দিনের কামাই দিয়াই বাসায় চাউল কিইন্যা নেই।’

জলের তলেই স্বপ্ন খোঁজে সুমনরা

মেঘনার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিপন্ন জনপদ ভোলার রামদাসপুর। নদী ভাঙনে দিশেহারা হাজারো জেলে পরিবার, বসতি ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করাই তাদের প্রধান কাজ। বংশপরম্পরায় চলে আসছে এ পেশা। জেলে নৌকায় কাজ করা অধিকাংশের বয়স আট থেকে পনেরো বছর। এদের কেউ বাবার সঙ্গে জাল টানে, কেউ ধরে নৌকার বৈঠা, কেউবা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ঝুড়িতে ভরে। দক্ষ জেলে হওয়ার শিক্ষাটা তাদের এভাবেই চলে। রয়েছে জোয়ার-ভাটার পাঠও। মাঝে মধ্যে মাছ নিয়ে বাবা হাটে গেলে উত্তাল নদীতে তখন জালের মুঠি তাকেই ধরতে হয়। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে পল্লীর অধিকাংশ শিশুর জীবনের গল্প একই। শিক্ষার আলো পৌঁছলেও আগ্রহ নেই অভিভাবকদের। স্কুলে যাওয়াকে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই ভাবে না তারা, বরং বড়দের সঙ্গে মাছ শিকারই শ্রেয়! 

নৌকায় একজন জেলের পক্ষে জাল টেনে মাছ ধরা অসম্ভব। তাই দরিদ্র জেলেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের ছোটদেরকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করে। এ কারণে স্কুল ছাড়তে হয় শিশুদের। জেলেপাড়ার শেখর দাস জানান, মাছ ধরা তাদের পৈতৃক পেশা। সন্তানরাও সেটা ধরে রাখবে। তাই মাছ ধরার কাজ শেখাচ্ছেন। ছেলেবেলা থেকে কাজ শিখলে বড় হয়ে দক্ষ জেলে হতে পারবে ওরা। জলের সঙ্গে কেমন করে যুদ্ধ করতে হয় জানতে পারবে, জানালেন শেখর দাস। 

বছর দশেকের সুমন জানায়, পাড়ার স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে সে। বাবা একা জাল টানতে না পারায় প্রতিদিনই এখন তাকে নদীতে নিয়ে যায়। নৌকার বৈঠা সে ভালোই বাইতে পারে। তবে এখনো তার মন পড়ে থাকে স্কুলেই। সুমন বলে, ‘ইস্কুলে যাইতে তো মন চায়ই, কামের লাইগ্যা যাইতে পারি না। জোয়ার আওয়ার আগেই জাল পাতি, আর ভাটায় পানি টানলে মাছ লইয়া আই। তয় আইতে আইতেই ইস্কুল ছুডি হইয়া যায়। মোগর আর হড়াল্যাহা (পড়ালেখা) হরার সময় থাহে না।’ 

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে দুই যুগ ধরে কাজ ওয়াহিদা বানু সামগ্রিকভাবে বলেন, ‘দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মা-বাবা ও অভিভাবকেরা পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। তাই তারা নিজের শিশুটিকে উৎসাহিত করেন যে কোনো কাজে নিয়োজিত হতে। তারা মনে করেন, সংসারে যত সন্তান ততই লাভ। আজও অনেকে বলেন- আল্লাহ দিছেন, আল্লাহই খাওয়াবেন। আবার কখনো কখনো শিশুরাই বেঁচে থাকার তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদেরকেও আয়বর্ধন কর্মকান্ডে সহায়তা করতে হবে সরকারকে। বিদ্যালয়ের খরচ দেওয়ার মতো সামর্থ্য দরিদ্র পরিবারগুলোর নেই, এ ক্ষেত্রে যদি পরিবারগুলোকে সেভাবে সহযোগিতা দেওয়া যায়; তাহলে অবশ্যই তারা সন্তানকে কাজে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠাবেন। তাছাড়া কর্মজীবী শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারলে অর্ধেকের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম কমে আসবে। যদিও বাস্তব চিত্রটা ঠিক উল্টো। সরকারি স্কুলগুলোতেও ইদানিং বিভিন্ন ফি ধরা হয়, যা দিতে না পেরে স্কুলেই ছেড়ে দেয় দরিদ্র ছেলে-মেয়েরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকার নিশ্চিত ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি শিশুর অধিকারকে যথাযথ বিবেচনায় নিয়ে একটি কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের। এটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই জাতীয় সব উন্নয়নসংক্রান্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় শিশু নীতিমালা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫