Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৩

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে

জাতীয় নির্বাচন কবে হবে- এ নিয়ে সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম এ রকম-
১. ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত হেফাজত : প্রথম আলো, ০৬ এপ্রিল ২০২৫।
২. ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি : ডেইলি স্টার, ০৬ এপ্রিল ২০২৫।
৩. অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস, বাড়ছে ভোটের চাপ : বিডিনিউজ, ১২ জানুয়ারি ২০২৫।
৪. সরকার কি চাপের কারণে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে? বিবিসি বাংলা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
৫. ডিসেম্বরকে ঘিরে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, সিইসি : খবরের কাগজ, ০৬ এপ্রিল ২০২৫।
৬. নির্বাচন কবে, ‘নিশ্চয়তা’ দিচ্ছে না সরকার : কালের কণ্ঠ, ১৭ মার্চ ২০২৫।

ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে চাপ বাড়ছে এবং সরকার ও তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডাররা যে বিচার ও সংস্কারের আগে নির্বাচন দিতে চায় না, তার কিছু ইঙ্গিত এখানে রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি একাই কি দ্রুত বা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়? তারা কি জুলাই অভ্যুত্থানে যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ অন্যান্য অভিযোগে মামলা হয়েছে, তাদের বিচার এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো চায় না? আর অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অন্য ইসলামিক দলগুলো নির্বাচনের ব্যাপারে যে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান করছে বা তাদের বক্তব্যের সঙ্গে অন্য দলগুলোর যে পার্থক্য, তার কারণ কী? অর্থাৎ বিএনপি কেন দ্রুত নির্বাচন চায়?

বিএনপি মনে করে, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তত বাড়বে। ফলে দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে এসব সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে বিএনপি এ বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। যদিও তারা এখন বলছে ডিসেম্বরের মধ্যে।

দলটি মনে করে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু নিশ্চিত করেই নির্বাচন দেওয়া উচিত এবং বাকি সংস্কারগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি চায় অধিকতর সংস্কার। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচনের পরে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে কি না, তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

এখানে যে প্রশ্নটি বারবার ঘুরেফিরে সামনে আসছে সেটি হলো, বিচার ও সংস্কারে যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য না হয় এবং এসব ইস্যুতে জনগণের ম্যান্ডেট না থাকে, তাহলে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারবে কি না? আবার জনগণ যদি ভোট দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা যারা আগে বিচার ও সংস্কার এবং তার পরে নির্বাচনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তাদের সরকার গঠনের ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে তাদের হাত ধরেই বিচার ও সংস্কারের বাকি কাজগুলো হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনের বিকল্প নেই।

মনে রাখতে হবে, জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুটা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে হলেও এর অন্তর্নিহিত একটি বড় কারণ ছিল নির্বাচন। অর্থাৎ বিগত সরকার যেহেতু বছরের পর বছর ধরে মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল; নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থেকেছে এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছিল, ফলে ছাত্র এবং রাজনৈতিককর্মীদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা ভেবেছিল, এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের ভোটাধিকার ফিরে আসবে। সুতরাং এখন নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করা হলে সেটি সাধারণ মানুষ কীভাবে নেবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন।

তার চেয়ে বড় কথা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে তখন সরকার সেটি কীভাবে মোকাবিলা করবে; তারাও অতীতের সরকারের মতো উন্নয়ন ও সংস্কারের দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবে কি না; তাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলকে নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তিশালী করে তুলতে যথেষ্ট সময় দিতে চাইবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দল তো বটেই, সাধারণ মানুষের মনেও নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। বিএনপি এখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে জোর দিচ্ছে শুধু তাই নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক মিত্ররাও যাতে এ বিষয়ে অভিন্ন সুরে কথা বলে, সেই চেষ্টা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ দেবেন, এটা বিএনপির জোরালো দাবি।

প্রসঙ্গত, হেফাজতে ইসলাম কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না হলেও মাদ্রাসাগুলোতে তাদের বিরাট ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তারা একটি বিরাট অরাজনৈতিক শক্তি, যা দেশের অনেক বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। জুলাই অভ্যুত্থানেও তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। ফলে হেফাজতে ইসলাম যদি বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে; এই ইস্যুতে বিএনপি যদি রাজপথে আন্দোলনে নামে এবং তাতে যদি হেফাজতে ইসলাম সমর্থন দেয়, তাহলে সেটি সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় চাপ তৈরি করবে।

এই মুহূর্তে আরেকটি বড় রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলাম। শুরুতে মনে হচ্ছিল তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। কিন্তু সম্প্রতি তাদের নেতাদের কথায় মনে হচ্ছে, তারাও এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চান। বাকি থাকবে জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা ডিসেম্বরের মধ্যে তো নয়ই, বরং বিচার ও সংস্কার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচনের পক্ষপাতী নয়।

অভ্যুত্থানের মুখে যে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, তারা যে গত আট মাসে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ব্যাপারটা তত সহজ নয়। মামলা ও হামলার ভয়ে নেতাকর্মীরা পালিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে এবং সরকার যদি সত্যি সত্যিই নির্বাচন বিলম্বিত করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার দলগুলো নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসবে কি না, সেটিও বিরাট প্রশ্ন। তখন পরিস্থিতি হয়তো আরো ঘোলাটে হবে। উপরন্তু শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বরং দ্রুত একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বিদেশি চাপও বাড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে তারা যদি বিচার ও সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে চায়, সেখানে জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সেটি বৈধতা পায় না। কোনো না কোনো দিন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আদালতে চ্যালেঞ্জড হবে।

সুতরাং এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিচার ও সংস্কার প্রশ্নে ঐক্য প্রয়োজন যে, তারা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কোন সংস্কারগুলোর ব্যাপারে একমত; বিচারের প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে তারা কী করবে এবং যে দলই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করুক না কেন তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে যে বাধ্য থাকবে, সে রকম একটি লিখিত ডকুমেন্টও থাকা দরকার।

এসব না হলে শুধু নির্বাচন ইস্যুতেই যদি সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং সরকারের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়তে থাকে; সরকার যদি অতীতের সরকারগুলোর মতোই দমন-পীড়নের পথে যায়, সেটি দেশের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ডেকে আনবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫