Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

স্বাস্থ্যসেবায় অগোছালো বাস্তবতা, দরকার গুণগত সংস্কার

Icon

ডা. মুশতাক হোসেন

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৮

স্বাস্থ্যসেবায় অগোছালো বাস্তবতা, দরকার গুণগত সংস্কার

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন একটি মিশ্র পদ্ধতিতে চলছে। সরকারি-বেসরকারি ও এনজিও মিলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠিত। তবে সব মিলিয়ে এটি একটি অগোছালো অবস্থায় রয়েছে, সুশৃঙ্খল না। সাধারণ মানুষকে পাঁচ ধরনের সেবা দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রোগ প্রতিরোধ, দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্য উন্নয়ন, তৃতীয়ত চিকিৎসা, চতুর্থত পুনর্বাসন এবং সর্বশেষ উপশমমূলক চিকিৎসা। এই পাঁচ ধরনের সেবাকে মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে হবে এবং অর্থের অভাবে কেউ যেন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়- এটি নিশ্চিতের জন্য যে সুশৃঙ্খল স্বাস্থ্যকাঠামো ও পরিচালনা পদ্ধতি প্রয়োজন এবং অর্থের সংস্থান প্রয়োজন তার কোনোটিই আমাদের নেই। 

আমাদের অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলা হয়। কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্যের মতো বিষয়ে যদি সে উন্নয়ন কাজে না লাগে তাহলে এর কোনো অর্থ নেই। কাজেই স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন করতে হলে প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থের অভাবে কেউ যেন এ দুটি সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।

সরকারি ও এনজিও খাতের সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা জনকল্যাণমূলক। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নামেমাত্র খরচ হয়। এ ছাড়া মুনাফাভিত্তিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান অবশ্যই মুনাফার জন্য কাজ করে। কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার যেসব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জনকল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে অনেকাংশেই উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ। সেখানে সাধারণ জনগণকে অনেক সময় ঘুষ বা উৎকোচের মাধ্যমে সেবা নিতে হয়। যেখানে বিনা পয়সায় সেবা পাওয়ার কথা, সেখানে দুর্নীতির কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পরও এগুলোই একমাত্র খাত যাদের বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে সেবা দেওয়ার কথা।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবনা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। কিছু বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আমার ধারণা, তারা বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করছেন। আগে থেকেই যারা এটা বাস্তবসম্মত নয় বলে প্রচার করছেন, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। তারা পরিবর্তন ও প্রগতির বিরোধী। এদিক-সেদিক কিছু পরিবর্তন করে বর্তমান পদ্ধতি চালু রাখা হলে তা স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে কোনো কাজ দেবে না। জনস্বাস্থ্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি সাহসী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমি আশা করি, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন তা করবে। বাস্তব নাকি অবাস্তব এটি বলতে বলতে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেছি। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ আর কবে বাস্তবায়ন হবে? 

ছাত্রদের নেতৃত্বে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আমরা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান করেছি। একটি শান্তিপূর্ণ পথে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে না পারায় একটি বিরাট ধরনের রক্তপাতের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের বিপ্লবাত্মক সমাধানের পথ খুলে গেল। তাহলে স্বাস্থ্য খাতে কেন গুণগত সাহসী পরিবর্তন হবে না? মানুষের কল্যাণের জন্য যদি রাষ্ট্রকে কাজে না লাগানো হয়, তাহলে এমন গণবিস্ফোরণ আমাদের মাঝেমধ্যেই প্রত্যক্ষ করতে হবে। কিন্তু বারবার রক্তাক্ত অধ্যায় একটি স্বাধীন-গণতান্ত্রিক দেশে কাঙ্ক্ষিত না। আমরা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবেই সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি বের করতে পারি। 

গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার অন্যতম হচ্ছে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সংস্কার কমিশনে যারা আছেন, আমি আশাবাদী তারা একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাবনা দেবেন। সেটা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জনবল আমাদের দেশেই রয়েছে। শুধু তাদের সঠিক স্থানে ব্যবহার করা দরকার। মাঝে মাঝেই খবর দেখি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ও মাঠ পর্যায়ে অনেক পদ শূন্য রয়েছে। আবার অনেক চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট উপযুক্ত কাজ না পাওয়ায় বেকার রয়েছেন বা অন্য কাজ করছেন।  

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সবার জন্য প্রাথমিক ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী বাজেটে আমরা সে ধরনের উদ্যোগ দেখতে চাই। সারা দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করতে হয়তো আগামী পাঁচ বছর লেগে যেতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে আমাদের সে লক্ষ্য পূরণে সম্পদের যেন কোনো অভাব না ঘটে। অতীতে লুটপাট হওয়া অর্থ উদ্ধার করে লুটপাটের সুযোগ বন্ধ করে যেন জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তা কাজে লাগানো হয়। এই খরচের প্রতিদান হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন।  সুস্থ-সবল জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে আমাদের জাতীয় সম্পদের অনেক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। 

কমিউনিটি ক্লিনিককে আরো পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। শহরসহ সব এলাকায় এটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসক পদায়ন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত একজন পুরুষ ও নারী চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। এর পাশাপাশি একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্যই তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্ট লাগবে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে অন্তত ১০ জন কর্মী লাগবে। যারা ঘরে ঘরে রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক তথ্য জানাবেন, জনগণের কাছ থেকে তথ্য জানবেন। এখন তা শুধু মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সীমিত আকারে সীমিত পরিসরে চালু আছে। কমিউনিটিভিত্তিক এ সেবার ব্যবস্থা সব রোগের এবং সবার জন্য করতে হবে। অর্থাৎ কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ডামাডোলে কমিউনিটি ক্লিনিক বাতিলের মতো কোনো সিদ্ধান্ত যেন সরকার না নেন। যদিও এখন  পর্যন্ত সে ধরনের কোনো খবর শুনিনি। কিন্তু অপারেশন প্ল্যান (ওপি) বন্ধের অজুহাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।   

স্বাস্থ্য খাতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার কমিশনের দেওয়া পরামর্শ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আমি আশা করছি। আগে সংস্কার কমিশন প্রস্তাব পেশ করবে, রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করবে। এরপর বোঝা যাবে সরকার গুণগত পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক কি না। কারণ এটার জন্য তো সংসদ প্রয়োজন হবে না। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর আগামী বাজেটগুলোতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। 

স্বাস্থ্যব্যবস্থার অর্থবহ সংস্কারে সরকারকে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের সব মানুষের কাছে মানসম্মত 

প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। কোনো মানুষ যেন টাকার অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় সেভাবে অর্থ সংস্থান করতে হবে। আমাদের অর্থ ও জনবল আছে। সারা দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হলে আমাদের আরো জনবল লাগবে। কিন্তু তা করার জন্য আমাদের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। সে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বর্তমান সরকার ও সব রাজনৈতিক দলকে করতে হবে। এ সরকারের সময় স্বাস্থ্য সংস্কার চালু হলে যেন ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার তা অব্যাহত রাখে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫