Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

নষ্ট যন্ত্রটা মেরামত করতেই হবে

Icon

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫০

নষ্ট যন্ত্রটা মেরামত করতেই হবে

শুরু থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে একটা যুদ্ধাবস্থায় দেখেছি। এটি ছিল কল্যাণের, মানুষের মুক্তির যুদ্ধ। ফ্যাসিবাদ থেকে, দেশীয় ও আঞ্চলিক দাসত্ব থেকে মুক্তির যুদ্ধ, সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ রাখার যুদ্ধ। এই যুদ্ধটি করার জন্যই জুলাই বিপ্লবের বিজয়ী বীরেরা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক প্রতিকূলতা ঠেলে লক্ষ্যে পৌঁছানো  ক্রমেই জটিল ও কঠিন হয়ে উঠেছে।

পলাতক ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী, প্রতিবেশী দেশের মিডিয়া ও সরকারের সহযোগিতা নিয়ে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করার জন্য ক্রমাগত উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডায় ব্যয় করছে। কখনো ডাকাতি, কখনো অগ্নিকাণ্ড, কখনো আইনজীবীকে পিটিয়ে হত্যা, কখনো আনসার বাহিনী আবার কখনো শিক্ষক বা অন্য পেশাজীবীদের উসকে দিয়ে দেশকে অস্থির করার একটা লাগাতার পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ও গ্রাউন্ডে দুই জায়গায়ই তারা ক্রমাগত অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। ১৫ বছরে পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া আওয়ামী ক্যাডারদের কাজে লাগিয়ে দেশকে স্থবির করার চেষ্টা ক্রমাগত করে চলেছে।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তির একটি বড় গোষ্ঠী একটু একটু

করে পুরোনো চরিত্রে ফিরে যাচ্ছে, ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান হলো, যার মধ্য দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে এ দেশের সহস্রাধিক তরুণ প্রজন্ম, তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। যেন তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য শুধু একটিই, অতি দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া এবং রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাটে ঝাঁপিয়ে পড়া। এরই মধ্যে তারা হাট-বাজার, টেম্পো-বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন চাঁদাবাজির হাবগুলোর দখল নিয়ে নিয়েছে।

সেদিন একজন মার্কিনপ্রবাসী বন্ধু জানালেন, তার ভাই ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন ছোট কর্মী, তিনিও প্রতি মাসে বিকাশের মাধ্যমে চাঁদার ভাগ ছয় হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। চাঁদাবাজির টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টিকে তারা মোটামুটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ফেলেছেন। নেতাকর্মীরা তাদের র‌্যাংক অনুযায়ী ঘরে বসেই মাসোহারা পেয়ে যান।

দুই যুগ আগে আমার এক পুলিশ বন্ধু সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে ছয় মাস হাসপাতালে ছিলেন। তখন তার ব্যয়বহুল সংসারটি চলছে কীভাবে জানতে চেয়েছিলাম। কারণ আমার ধারণা ছিল, পুলিশ যখন ডিউটিতে থাকেন তখন ঘুষ গ্রহণ করার সুযোগ পান, এটিই তাদের প্রধান আয়। তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আমাদের সব সিস্টেম করা আছে, কে কত পাবে তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলে আসে। ছুটিতে থাকলেও ভাগের টাকার হেরফের হয় না। এখন দেখছি সেই সিস্টেম রাজনৈতিক দলগুলোও করে ফেলেছে। একটি দেশের অনৈতিক কার্যকলাপ যখন এই পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন সেই দেশকে কে এসে উদ্ধার করবে?

বলছিলাম অন্তর্বর্তী সরকারের যুদ্ধের কথা। এই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল নষ্ট হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রটিকে মেরামত করা। রাষ্ট্র সংস্কারের শপথ নিয়ে সরকার ভীষণ উদ্যমে কালক্ষেপণ না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই কাজে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, মেধাবী নাগরিকদের সমন্বয়ে বেশ কিছু সংস্কার কমিশন করেছে। সেসব কমিশন মাত্র তিন মাসের মধ্যে বহুপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও গণমানুষের কল্যাণচিন্তা কেন্দ্রে রেখে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং তা প্রস্তাবাকারে সরকারের কাছে জমা দেয়।

এখন শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপ। কমিশনগুলোর কাজের সমন্বয় করার জন্য একটি

ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান স্বয়ং সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ

ইউনূস। এই কমিশন সব কমিশনের সুপারিশ-প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করবে কোন সুপারিশ এই মুহূর্তেই, মানে নির্বাচনের আগে বাস্তবায়িত হবে এবং কোনগুলো পরে, নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে।

অনুমান করছি, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বিএনপি আপত্তি জানাবে। কারণ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার কাটাছেঁড়া করে এমন একটি সংবিধান তৈরি করেছে, যেটি ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য সুবিধাজনক। কোনো নিরপেক্ষ সরকার নয়, নির্বাচন হবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই বিচার বিভাগ সংসদের অধীন ইত্যাদি আরো বহুকিছু।

এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হলে এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা যে সংবিধান সংস্কার করবে এমন প্রতিশ্রুতি এ দেশের জনগণ বিশ্বাস করে না। কারণ অতীতে কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় গিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে তাদের একটি কাজই করতে দেখেছি, বিরোধী মত দমন এবং ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার ফন্দিফিকির।

রাষ্ট্র সংস্কারই অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট ও বৈধতা। যদি এই কাজ তারা করতে না পারেন, তাহলে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে তারা একটি গণধিকৃত সরকারে পরিণত হবেন এবং সরকার থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে নানা আইনি হয়রানির মুখোমুখি হবেন। মনে রাখতে হবে দেশের মালিক দেশের জনগণ, আইন না মেনেও যদি কেউ জনকল্যাণে কাজ করে জনগণই তাকে আইনের নিষ্ঠুর হাত থেকে রক্ষা করে।

সরকার যথার্থই তাদের কাজের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সংস্কার কাজে নেমেছে, অনেক দূর এগিয়েছেও। সংবিধান সংস্কার ছাড়া বাকি সংস্কার কাজে তেমন আইনি জটিলতা নেই, কাজেই অন্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কোনো জাতীয় সংলাপের দরকার নেই, কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু করে দিতে হবে। শুধু সংবিধান সংস্কার নিয়ে জাতীয় সংলাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও সরকারকেই চালকের আসনে বসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে না এলে প্রধান পরিবর্তনগুলোর একটি তালিকা করে অনলাইন জরিপ করা যেতে পারে। যেমন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংসদের উচ্চকক্ষ থাকবে কী থাকবে না ইত্যাদি। অনলাইন জরিপে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেলে একটা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। অথবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোই দেশের একমাত্র স্টেকহোল্ডার নয়। দেশের এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীই দেশের মালিক, যারা কোনো রাজনৈতিক দল বিলং করেন না, তারাই সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার, তারাই জুলাই বিপ্লব সফল করেছেন। সংস্কার প্রশ্নে তাদের মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  তাদের মতামতকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। মোদ্দাকথা সংস্কারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যা যা করার সেই পথে সরকারকে হাঁটতে হবে।

দায়িত্ব নিয়েই ড. ইউনূস বলেছিলেন, যন্ত্রটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এটা মেরামত না করলে এগুবো কী করে? মূল জায়গায় হাত দিতে হবে, সংবিধানটাই ঠিক করতে হবে। দায়িত্ব ছাড়ার আগে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই, যন্ত্রটা যতটা সম্ভব মেরামত করে দিয়েছি, এখন দেশ এগিয়ে যেতে পারবে। কিছুতেই আপনার মুখ থেকে এ কথা শুনতে চাই না, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কিছুই করতে পারলাম। নষ্ট যন্ত্র পেয়েছিলাম, নষ্ট যন্ত্রই দেশবাসীর জন্য রেখে গেলাম। আপনি না পারলে এই নষ্ট যন্ত্র মেরামত করতে আর কে পারবে স্যার?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫