Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মে দিবস: দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার ডাক দেয়

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ০৯:৪৮

মে দিবস: দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার ডাক দেয়

ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রবার্ট ওয়েনের চিন্তাধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নগুলো দিনে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। কর্মসূচির স্লোগান ছিল, ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন ও আট ঘণ্টা বিশ্রাম’। স্লোগানটি ঠিক করেছিলেন রবার্ট ওয়েন নিজেই।

১ মে শিকাগোতে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি হয়। সেদিন প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন। সে সময় কারখানার শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ঠিক করা ছিল না। ফলে বিশ্রাম ছাড়াই কারখানা মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী টানা কাজ করে যেতে হতো। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-কারখানা ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কেন্দ্র ছিল শিকাগো। তাই আন্দোলনটি এখানেই ব্যাপকতা লাভ করে। শ্রমিকদের টানা আন্দোলন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ৩ মে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন শ্রমিক মারা যান এবং অনেকে আহত হন। পুলিশের এই নিষ্ঠুরতায় ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পরদিন ৪ মে শিকাগোর বিখ্যাত হে মার্কেট স্কয়ারে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়। সেদিন অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়লে চারজন বিক্ষোভকারী শ্রমিক নিহত হন এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হন। পুলিশের সাতজন সদস্য নিহত এবং ৬৭ জন আহত হন। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায় ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ হিসেবে।

১৮৮৬ সালের ওই শ্রমিক আন্দোলনের স্মরণে ১৮৮৯ সালে ২০ দেশের সমাজকর্মী ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ১ মে দিনটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক অধিকারের পক্ষে সারা বিশ্বে আজও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

আমাদের দেশে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে পোশাক শ্রমিকরাই অগ্রগণ্য। এ খাতেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন দেশে। পোশাকশিল্পের কথা বলতে গেলে এ শিল্পের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা আসবেই। মাসের পর মাস বেতন না দেওয়া, ওভারটাইমের টাকা না দেওয়া, কথায় কথায় ছাঁটাই-এ অভিযোগগুলো হরহামেশাই খবরের শিরোনামে উঠে আসে। এসব ন্যায্য পাওনা আদায়ে পোশাক শ্রমিকদের প্রায়ই রাস্তায় নামতে হয়। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডাটাবেইস) অনুযায়ী, তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে ৫২.২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী নিট খাতে ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জনই নারী।

সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতে মোট লোকবল ৪৩ লাখ ১৬ হাজার। এত বড় সংখ্যার শ্রমিকের জীবন কতটা নিরাপত্তাহীন, সেটা আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি। ২০২১ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ‘১০ বছরে শিল্প-কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা গেছে ৭০০ জন শ্রমিক।’ তা ছাড়াও রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টসের ঘটনা দিয়ে বোঝা যায় দেশের শ্রমিকরা কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো কৃষি। কৃষকরাও ভীষণ সংকটে দিনাতিপাত করছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে প্রায় আড়াই কোটি কৃষি শ্রমিক রয়েছেন। অথচ কৃষি খাতই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম থেকে আজও বঞ্চিত হন, আর মধ্যস্বত্বভোগীরা হয় লাভবান। একুশ শতকে এসেও দেনা পরিশোধ করতে না পেরে বহুজন আত্মহত্যা করেন।

একই অবস্থায় বাস শ্রমিক, রিকশা শ্রমিকসহ এ খাতের সব শ্রমিক সড়কে এক শ্রেণির চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি। শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি ও সম্মান আজও আদায় হয়নি। দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকদের যথাযথ স্বীকৃতিও নেই। বঞ্চনার মধ্য দিয়ে তাদের ওঠাবসা। মে দিবস কী ও কেন, তা দেশের বেশির ভাগ শ্রমিকরা জানতে পারেননি কোনো সময়। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রমিক সংগঠন আছে। মে দিবসে শ্রমিকদের দিয়ে তারা লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে মিছিল করায়। এক বেলা খাবার আর এক দিন বন্ধ ছাড়া মে দিবস সেই শ্রমিকদের কাছে নতুন কোনো বার্তা নিয়ে আসে না। আমাদের দেশের শ্রমিকরা বঞ্চনার মধ্য দিয়ে যে জীবন শুরু করে, যুগের পর যুগ সেভাবেই চলে। এর থেকে তার মুক্তি আর মেলে না।

মে দিবসে দুটো বিষয় প্রধানত সামনে আসে। এক. মজুরি, দুই. কাজের ঘণ্টা ও কাজের পরিবেশ। বাংলাদেশ এখনো পৃথিবীতে সস্তা শ্রমিকের দেশ হিসেবেই পরিচিত। আর শ্রমিক নারী হলে তো কথাই নেই। নারী-পুরুষের একই কাজে একই মজুরির দাবি দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুসারে, ২০১৬-১৭ প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শ্রমবাজারে নারী-পুরুষ অসমতা কিছুটা কমলেও তা ৩৭ শতাংশের বেশি। গ্রামে নারীর শ্রমে অংশগ্রহণ প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে। ফলে গ্রামে নারী-পুরুষের অসমতার ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে।

শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার এখনো অধরা। শ্রমিকদের সংগঠনগুলো দুর্বল। প্রতিটি খাতের মালিক শ্রেণির অনুগত শ্রমিক সংগঠন  শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। শ্রমিকের রক্তে গড়ে ওঠা আন্দোলন বিক্রি করে দেয় শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে লুকিয়ে থাকা মালিক শ্রেণির অনুগত চর। তবুও প্রতিটি বছর মে দিবস আসে, শ্রমিক অধিকারের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার ডাক দেয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫