Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

যুগে যুগে গোপন বন্দিশালা

Icon

ড. মো. আবুল হোসেন

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ১৯:১২

যুগে যুগে গোপন বন্দিশালা

পৃথিবীতে একসময় মানুষের বসবাস ছিল স্বাধীন জনপদে। এ রকম একটা জনপদ স্বাধীনভাবে শত বছর ধরে টিকে থাকতে পারে। মানুষ নিজেদের ফসল ফলানো, সম্পদ অর্জন, চিকিৎসা, শাসন ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা করে সেই জনপদে।

একটা নদীর পারের স্বাধীন জনপদ কেমন হবে? তারা মাছ ধরবে, নৌকা বানাবে; দূরের অন্য একটি জনপদে যাবে, এসব পণ্য বিক্রি করবে। নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে আনবে। এভাবে বছর ঘুরে একে অপরের কাজে আসবে। এ রকম হাজারো স্বাধীন জনপদ দিয়ে মানবজাতি হাজার বছর ধরে টিকে আছে। এই জনপদগুলো ছিল সুখের স্বর্গ। এ রকম একটা সুখের স্বর্গে একসময় অন্য এক জনপদ আক্রমণ করে, সম্পদ লুট করে, খুন করে, বন্দি করে মানুষ নিয়ে যায়। এ রকম একটা দুর্ঘটনা সময়ের গভীর তলে হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ রকম অনেক গল্প এখনো টিকে আছে। যেমন- বহু বছর ধরে একটা দ্বীপে বসবাস করা জনপদ সুখেই ছিল। তারা জানত না যে তারা ছাড়া পৃথিবীতে আর অন্য কেউ আছে। কিন্তু একদিন কিছু মানুষ নৌকা নিয়ে তাদের দ্বীপের খোঁজ পায়। তারা দেখে-এই দ্বীপে সম্পদের খনি। তাদের মধ্যে একটা যুদ্ধ হলো। এক জনপদ আরেক জনপদ দখল করে নিল। এই দুই জনপদ এখন এক জনপদ হয়ে গেল। যা হলো দখলকৃত জায়গা বড় হলো, মানুষ বাড়ল, সম্পদ বাড়ল। একসময় এরা সবাই একটা জাতি হিসেবে আবির্ভূত হলো। একসময় আরেকটি যুদ্ধবাজ জনপদ তাদের আক্রমণ করল। এই প্রথা চলতে থাকল।

একসময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মানবজাতি মানুষের সবচেয়ে খারাপ দিক দেখল। হত্যা করা হলো ৭৫ মিলিয়ন মানুষ। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অনন্তকাল ধরে মানবজাতির মাঝে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা। প্রশ্ন হলো, কীভাবে? উত্তর- ‘গোপন বন্দিশালা’। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় জেলখানা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে কী হয়? 

কিছু মানুষকে আদালতের মাধ্যমে কৃতকর্মের জন্যে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের সমাজ থেকে আলাদা করে নির্দিষ্ট মেয়াদে রাখা হয় জেলখানায়। জেলখানায় সবকিছুরই একটা ব্যবস্থা হয়। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সাজা অনুযায়ী অধিকার থাকে। আশা করা যায় যে একসময় তারা তাদের অপরাধ বুঝতে পারবে এবং সমাজে পুনরায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। এই ব্যবস্থায় অপরাধীদের সামাজিক পুনর্বাসনের সুযোগও থাকে। আবার একইভাবে আদালতের মাধ্যমে জেলখানায় ফাঁসি দিয়ে বা অন্য কোনো ব্যবস্থায় মানুষকে মেরে ফেলারও ব্যবস্থা রাখা হয়। এত সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকার পরও বিভিন্নরূপে মানুষকে সমাজ থেকে আলাদা রাখতে নাৎসি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ‘গোপন বন্দিশালা’ ব্যবহার করে। সাধারণভাবে পুলিশ, আদালত ও জেলখানার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ‘গোপন বন্দিশালা’র প্রয়োজন পড়ে। এসব ‘গোপন বন্দিশালা’ অনন্তকাল ধরে শান্তির জনপদে যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে যোদ্ধা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

এই লেখার শুরুতে একটা সুখী-সমৃদ্ধ স্বাধীন জনপদের কথা বলা আছে। কীভাবে এখানে যুদ্ধ শুরু হলো? সবচেয়ে সহজ হলো, আক্রমণ করা। কিন্তু তাতে খুব বেশি হলে স্বল্প সময় ধরে একটা যুদ্ধ চলবে। ফলাফল হবে এক জনপদ অন্য জনপদকে ধ্বংস করা। কিন্তু নাৎসি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ‘গোপন বন্দিশালা’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হলো। এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জনপদের সবাইকে হত্যা না করে কিছু মানুষকে অত্যাচার করে, আহত করে, আর কিছু মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দি অবস্থায় পরিকল্পিতভাবে তাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মৃত্যু ছাড়া আর যত রকমের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া যায়, তার সবই ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে বন্দিদের মনে আকাক্সক্ষা তৈরি চরম ঘৃণা ও প্রতিশোধের হবে। বন্দিদশা আরো দীর্ঘ করা হলে একসময় এই মানুষের মনে নিজের জন্যে মৃত্যু কামনা ছাড়া আর কিছুই আসে না! এই অবস্থায় চলার মাঝেই একদিন কোনো কারণ ছাড়াই এই বন্দিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলাফল অবিশ্বাস্য-নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে যখন একজন ব্যক্তি সমাজে বেঁচে ফেরে, তখন তার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া বোঝা খুব সোজা। তার দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়- এক. সে ট্রমার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বাকি জীবন পার করে। দুই. সে কিছুদিন সময় নেবে, নিজেকে গুছিয়ে নেবে এবং নবচেতনায় নিজেকে আবিষ্কার করবে। এখন তার মানসিক শক্তি যে কারো থেকে বেশি। সে নিজেকে সেই শক্তির বিরুদ্ধে বিবেচনা করবে যে তাকে বন্দিদশায় রেখে নির্যাতন চালিয়েছে। এখন সে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে। একসময় সফলতা অর্জন করবে এবং শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এ রকম আরো অনেক নির্যাতিত ব্যক্তি এক হয়ে প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখতে ‘গোপন বন্দিশালা’ যোদ্ধা তৈরি করে। 

এই যোদ্ধারা মানুষ হত্যার মতো ভয়ানক অপরাধ করেও সচেতন মনে যুদ্ধ করে। এই মানসিক শক্তি তারা অর্জন করে যখন তারা ‘গোপন বন্দিশালা’য় প্রতিদিন নিজেদের মৃত্যু কামনা করত। সাধারণ একজন ব্যক্তিকে কীভাবে ভয়ানক যোদ্ধা বানানো যেতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই বন্দিদশা। অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ চলমান রাখতে এই পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে জাতিগত অথবা অবস্থানগত কারণে যুদ্ধ ও সহিংসতা চলছেই। এসব যুদ্ধ ও সহিংসতার কোনো শেষ নেই।

এসব ক্ষেত্রে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে যোদ্ধা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলেই শান্তি বিরাজমান। অথচ এই শান্তির সময়ে ‘গোপন বন্দিশালা’র মাধ্যমে অনন্তকাল ধরে শান্তির জনপদে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন যোদ্ধা তৈরি করা হচ্ছে। এই চক্র থেকে কি বের হওয়ার কোনো উপায় আছে? বাস্তবসম্মত কোনো উপায় নেই। তবে একটা সাধারণ তত্ত্ব হলো প্রচলিত পদ্ধতিতে আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরি করতে হবে, যেন কাউকে গোপনে বন্দি রাখা না হয়। অন্যদিকে ‘গোপন বন্দিশালা’ থেকে মুক্তি পাওয়া এসব বন্দিকে যদি সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা যায়, সুন্দর পারিবারিক জীবন দেওয়া যায়, আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া যায় এবং সর্বোপরি তাদের বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করা যায়, তবেই এই চক্র থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। তাদের বোঝাতে হবে, ‘he who lives by the sword, dies by the sword’.


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫