
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি চিত্র
জুলাই আন্দোলন যখন শুরু হলো, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় যাবে এই আন্দোলন। তবে এটা জানতাম, নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যতজনকে দরকার খুন করে ফেলতে অনুমতি দেওয়াটা শেখ হাসিনার জন্য খুবই স্বাভাবিক।
এই জানাটা কোনো ধারণা থেকে আসেনি। বরং ২০০৮-এর পর থেকে বিডিআর হত্যাকাণ্ড, হেফাজত কিলিং, সাঈদীর বিচারকালীন ম্যাস মার্ডার, পুরো সময়ব্যাপী হতে থাকা গুম আর খুনগুলো থেকেই বুঝে নিয়েছিলাম; হাসিনার পতনের জন্য আসলে অনেক রক্ত লাগবে। কিন্তু সেই অনেক রক্ত যে এত জলদিই দেখে ফেলতে হবে বুঝিনি। বুঝিনি এত রক্ত আমাদের দেখতে হবে।
আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার পর থেকে পুরো সময় কেমন এক লহমায় কেটে গেছে-তুমুল উত্তেজনা, চেপে রাখা দুঃখ, একটা প্রবল আশায়। দিন গড়াচ্ছিল, মানুষ হতাহত হচ্ছিল, সেই সময়ে আসলে আমরা বুঝতে পারছিলাম না, হতাহতের মাত্রাটা কতটা বেশি, কতটা ভয়াবহভাবে মানুষকে মারা হয়েছে ক্ষমতা সংহত করতে।
আমিই বিকল্প
দিন গড়াচ্ছিল, আর যখন হাসিনার পতনের আলাপ ওঠে, একই সঙ্গে আলাপ আসে, এরপর কার কাছে ক্ষমতা যাবে, কে ক্ষমতায় গিয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে, দেশকে চালাবে? কারণ দেশে কোনো নেতৃত্ব নেই, বিকল্প নেই হাসিনার। অথচ হাসিনা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে রেখেছিলেন। দুটো ভোটবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে, ক্ষমতায় চড়েছিলেন। বিরোধী দলকে নির্মুল করে দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন, বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে ৬০ লাখ মামলা হয়েছিল তার সময়ে। নিজে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছিলেন, প্রতিটি সেক্টরে নিজের লোক বসিয়ে, তাদের দিয়ে রেখেছিলেন অসীম ক্ষমতা। এতটাই সীমাহীন ক্ষমতা ছিল যে, হাসিনার পিয়ন অবধি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। এমন একটি বিভাগ ছিল না, যা নষ্ট করে দেওয়া হয়নি, দলীয় আজ্ঞাবহ লোক বসানো হয়নি, অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ফলে আমরা হাসিনার পুরো সময়ে বলতাম, তিনি যদি নিজেই সরে যেতে চান কখনো, আমলারাই তাকে টিকিয়ে রাখবেন, যেতে দেবেন না, নয়তো তাদেরই বোল খুলে যাবে। সে জন্যই হাসিনার গোটা সময়জুড়ে একটিই আলাপ ছিল, বিকল্প কে? আর আমাদের প্রগতিশীলদের একটা বড় অংশ এই আলাপে যোগ দিয়ে হাসিনার অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছিলেন।
আর তাই আমরা বলেছিলাম, আমিই বিকল্প। সেই সময় ছিল অসাধারণ, সেই সময়ের স্বপ্ন ও আবেগ এখনো তাড়িত করে, এখনো চোখ ছলছল করে দেয়, দেশপ্রেমের আবেগে থরথর করে কাঁপায় সমগ্র অস্তিত্বকে। সেই সময়ে দেশের সব মেধা একত্র হয়ে গিয়েছিল, দেশের সেবা করার নিয়তে। রিভার্স ব্রেইন ড্রেন হ্যাশট্যাগে সবাই লিখছিলেন, কীভাবে দেশের কাজে আসতে পারেন তিনি। সেসব পোস্ট পড়ে চোখে পানি এসেছে কতবার!
৫ আগস্টের পর
৫ তারিখে রাস্তায় নেমে পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম, আর কাঁদছিলাম। কাঁদছিলাম আমাদের আহত ও শহীদদের কথা মনে করে, এত খুন, রক্তের পর আমরা পেয়েছিলাম একটা গণতান্ত্রিকতার মুহূর্ত। আমরা সেই সময়ে চাইলেই বানাতে পারতাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত একটি রাষ্ট্র।
পারতাম, কারণ সেই সময়ে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সব রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নির্বিশেষে সবার একটাই লক্ষ্য ছিল, হাসিনার পতন। সেই আন্দোলনে কেউ কারো পরিচয় দেখেনি, কারো রাজনৈতিক কাঙ্ক্ষিত-অভিপ্সা দেখেনি, দেখেনি ধর্ম বিশ্বাস।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল একটি সুন্দর দেশ হয়তো আমরা পেতে যাচ্ছি, যেখানে কোনো বৈষম্য হবে না। গুম-খুন হবে না, হওয়ার ভয় থাকবে না। বাকস্বাধীনতা পাব। সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ওপরে চড়াও হবে না। লোকে ধর্ম, বিশ্বাস ও পরিচয় নির্বিশেষে সমান সুবিধা, অধিকার ও ন্যায়বিচার পাবে। ভাবতে বসেছিলাম আর দুর্নীতি হবে না, দুর্নীতির টাকা ফেরত আসবে। দেশের শিক্ষা খাতের অন্যায্যতা দূর হবে। শিক্ষার হার বাড়বে। আমাদের গবেষণায় ও বিজ্ঞানে শিল্প জাগরণ ঘটবে। আমরা আনন্দের দেশ পাব।
সেই পুরো সময়টা ইন্টারনেট বন্ধ ছিল, ফলে কোনো সংবাদ আসত না। পত্রিকায় দেখতাম এত লোকের মৃত্যু, কিন্তু মৃত্যুগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল বুঝতে পারিনি। আমাকে আগস্টের পর এক ডাক্তার বলেছিলেন, ১৯ জুলাই তিনি একশর ওপরে লাশ দেখেছেন। সেই লাশগুলো নিখুঁত বুলেটেই বেশির ভাগ নিহত হয়েছেন, একটা ছোট গর্ত
মাথায়, বুকে ও পেটে। আর ৫ তারিখে দেখেছেন বীভৎসতা। কারো হাত নাই হয়ে গেছে, কারো পেট, মাথা। অদ্ভুত একটা রক্তক্ষয়ী সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলাম।
প্রতি স্বৈরশাসককে হটাতেই রক্ত লাগে। মধ্যপ্রাচ্যে আমরা যেমন দেখেছিলাম আরব বসন্তের পর। কিন্তু রক্তের ভার যে এতটা কঠিন, আমি হাসিনার পতনের পর বুঝেছিলাম।
প্রত্যাশা আর বাস্তবতা
জুলাই অভ্যুত্থান মানুষের ঐক্যবদ্ধতা ধরে রাখার এবং পটপরিবর্তনের সোনালি সময় ছিল। কিন্তু যারা এই আন্দোলনের মাথায় ছিল তারা সেই সুযোগকে লুফে নিতে পারেনি। আমাদের ঠিক করা দরকার ছিল কোন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করব, কী পরিবর্তন করব, আর কোন বিষয়গুলো রেখে দেব।
আমাদের প্রায়োরিটির তালিকায় থাকা উচিত ছিল, সংবিধানের সংশোধন, যাতে আরেকজন হাসিনা কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে আমাদের ওপর চড়ে বসতে না পারেন। আমাদের সংবিধান তত্ত্বভিত্তিক না হয়ে নাগরিকের চাহিদাভিত্তিক হওয়া দরকার। রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক ভিত্তি হওয়া দরকার প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশ, বহুত্ববাদ, আইনের শাসন আর জবাবদিহি। প্রায়োরিটি তালিকায় দরকার ছিল আমলতন্ত্রের সংস্কার, যাতে আমলারা নাগরিকের প্রভু হয়ে উঠতে না পারেন, শিক্ষার সংস্কার, নির্বাচন কমিশনের বস্তুনিষ্ঠতা এসব। কিন্তু আমরা করতে পারিনি।
তাড়াহুড়া করে ক্ষমতায় বসে যেতে হয়েছে-এর পেছনে নানা কারণ থাকলেও আমি মনে করি সেগুলো আদতেই ঠুনকো। কারণ সেই সময়ে আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের জনতা সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা পারলাম না। আমরা আলাপ করতে পারলাম না সবার সঙ্গে, কীভাবে ক্ষমতা হবে, কীভাবে প্রায়োরিটি ঠিক হবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হবে। দেখলাম কেউ কারো সঙ্গে সঙ্গে আলাপই করল না। বরং কোথা থেকে কেমন করে যেন কী সব সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। ক্ষমতায় বসবেন প্রফেসর ইউনূস, আমরা আনন্দিত হলাম।
কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা খাই ৮ তারিখে, যেদিন হাজারো মানুষের রক্ত মাড়িয়ে পাওয়া ক্ষমতায় বসতে উপদেষ্টারা আমলাদের নির্ধারিত মার্সিডিজে চড়ে বসলেন, এমনকি আমাদের ছাত্র উপদেষ্টারাও। মনে হলো, এত রক্তও তাদের ক্ষমতার ঠাটবাটে ঢুকে যেতে বাধা দিতে পারল না। এই কথা যখন আমি মানুষকে বলি, তারা বলে, এইটা তো নিয়ম। ওরা নিয়ম মেনেছে কেবল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, মানুষ থেকে দূর হয়ে যাওয়ার এটা প্রথম পদক্ষেপ।
পৃথিবীতে এমন অনেক প্রমাণ আছে, যারা ক্ষমতা পেয়েও মানুষের থেকে দূরে যায়নি, বরং কাছাকাছি থেকেছে। আর এই আন্দোলন, আন্দোলনের ক্ষত, পরবর্তী ক্ষমতা-সবটাই তো মানুষের জন্যই, ক্ষমতার কাছ থেকে, কোটার কাছ থেকে, কয়েকজনের কাছ থেকে মালিকানা ছিনিয়ে নিয়ে সবাইকে দেওয়া, প্রতিটি মানুষের কাছাকাছি হওয়া; যেভাবে আন্দোলন সবার হয়ে উঠেছিল।
সেই যে না হওয়া তার পর থেকে অনেক অপ্রাপ্তি, অনেকটাই দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে একটি বছর চলে গেছে। আমরা দেখেছি, ক্রমে মানুষ ক্ষমতায় তার ভাগ বুঝে নেওয়ার কথা ভাবছে। ফলে সংখ্যায় যারা গরিষ্ঠ, তারা লঘিষ্ঠের ওপর চড়াও হতে শুরু করল। ধর্মের নামে, চিন্তার শুদ্ধতা-নানা নামে। ফলে হিন্দুর বাড়িতে আক্রমণ হলো, মাজার ভাঙচুর হলো। আমরা দেখতে থাকলাম চিন্তায়, পরিচয়ে, পেশায় যারা পিছিয়ে, যাদের ক্ষমতা কম তারা ক্রমাগত আহত, আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আর আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী সেই আক্রমণের ঐতিহ্য প্রমাণ করে যাচ্ছেন, গেছেন।
কিছু পরিবর্তন হয়নি, তা না, হয়েছে। কিন্তু আমাদের আকাশে পৌঁছা আশাগুলো কোথাও মাঝ আকাশেই থেমে গেছে। একটি সুন্দর নির্বাচন হলে হয়তো আবারও আশা করতে পারব, দেশটাকে নিয়ে। নির্বাচনে জিতে যে দল ক্ষমতায় আসবে, আশা করি সেই দল কখনো হাসিনা হয়ে উঠতে চাইবে না। সেই দল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। যেখানে ভিন্ন চিন্তা, পরিচয় ও ধর্ম বিশ্বাসকে ধারণ করার দায়ে আক্রমণের মুখে পড়তে হবে না। যেখানে প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশকে মূল লক্ষ্য নিয়ে আগানো হবে, একটা প্রাণও যেখানে নষ্ট হবে না, বরং প্রাণের বিকাশ ও উৎকর্ষই হবে সেই একমাত্র লক্ষ্য। প্রকৃতিকে রক্ষা করা হবে সবার আগে। যার জন্য আমরা চোখ ছল ছল করে অপেক্ষা করছি।
লেখক : গবেষক