উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হোক শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে

জয়নাল আবদীন
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০০

দেশের বিদ্যমান এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার নির্বাচিত সদস্য ৩০০ জন। অনির্বাচিত নারী সদস্য ৫০ জন। প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ১০০ জন হলে, মোট দুই কক্ষ মিলে সংসদ সদস্য সংখ্যা হবে ৪৫০ জন। ভৌগোলিক সীমা রেখার ভিত্তিতে নির্বাচিত ৩০০ জনের সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। নারী সদস্যরা মনোনীত হন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী প্রত্যেক দলের পছন্দের মাধ্যমে। উচ্চকক্ষের ১০০ জনও যদি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হয়, সংসদীয় ব্যবস্থার গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হবে কি? বিদ্যমান ব্যবস্থার সদস্যদের গুণগতমান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণেই উচ্চকক্ষ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বহু দেশেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা রয়েছে। অনেক দেশের উচ্চকক্ষকে অলংকারের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই নেই। শুধু জনগণের অর্থের অপচয় করা হচ্ছে।
আবার অনেক দেশের Upper House আইন প্রণয়নসহ যাবতীয় সংসদীয় কর্মকাণ্ডে এত দক্ষ ও অভিজ্ঞ যে দেশ পরিচালনায় তাদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমেরিকার সিনেট সভা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী উচ্চকক্ষ। আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে উচ্চকক্ষ অনেক সময় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, অর্থবিল পাসের ক্ষেত্রে নাকানি-চুবানি খাওয়ায়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিশ্বে শক্তিধর। কিন্তু সিনেটের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার গর্দানও এদিক-ওদিক করতে পারে না। বিদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগেও সিনেটের অনুমোদন লাগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে কোনো আইন পাস হয়ে উচ্চকক্ষ বা সিনেটে পাসের জন্য উপস্থাপন হলে সেই বিলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বেশির ভাগ আইনেরই ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করে ফেরত দেওয়া হয়। আমাদের দেশের মতো ইয়েস নো দিয়ে আইন পাস করা যায় না।
যুক্তরাজ্যের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের সদস্যরা ছিলেন দেশের সবচেয়ে মেধাবী। যোগ্য ও অভিজ্ঞ নাগরিকদের ক্লাবের মতো। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির বাইরে দেশের মেধাবী ও অভিজ্ঞ নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। যদিও লর্ড সভা এখন বিলুপ্ত, কিন্তু যে কায়দায় আমাদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি কি আদৌ গুণগত মানের পরিবর্তন আনবে? এমনিতেই ৩৫০ জন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির ঠেলায় দেশের মানুষ কুপোকাত। তাদের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার অনেকটাই জনগণের অর্থের অপচয়। সংসদ সদস্যরা জনগণের জন্য যে কী করেন তা আমরা সবাই জানি।
বর্তমানে একজন সংসদ সদস্যের বেতন-ভাতা ও রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার খতিয়ান হচ্ছে প্রতি মাসে বেতন ৫৫ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকায় ভাতা প্রতি মাসে ১২ হাজার ৫০০ টাকা, সম্মানী ভাতা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা, প্রতি মাসে পরিবহন ভাতা ৭০ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকার অফিস খরচ মাসে ১৫ হাজার টাকা, মাসিক লন্ড্রি ভাতা এক হাজার ৫০০ টাকা, মাসিক ক্রোকারিজ ও টয়লেট্রিজ কেনার ভাতা ছয় হাজার টাকা, দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ এক লাখ ২০ হাজার টাকা, স্বেচ্ছাধীন তহবিল বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকা, বাসায় টেলিফোন বাবদ প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া উন্নয়ন কাজের জন্য একজন সংসদ সদস্য প্রতি বছর ২০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি, ন্যাম ফ্ল্যাটের বরাদ্দ সংসদ সদস্যের পরিবারের সবাই লাল পাসপোর্টÑএই যে বিশাল হাতি পোষার খরচ জনগণ বহন করে, জনগণ বা দেশ তাদের কাছ থেকে কী পায়? নিম্নকক্ষের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের ওপর উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য মনোনীত হলে তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা কেমন হবে, কোন যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা টঢ়ঢ়বৎ ঐড়ঁংব-এর মান্যবর সংসদ সদস্য হয়ে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারের মিশনে নাম লেখাবেন, তার কিছুই আমরা জানি না। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদের সদস্য হোক বা স্থানীয় সরকারের কোনো ইউনিটের জনপ্রতিনিধি হোক, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রশাসন পরিচালনার দক্ষতা কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয় না। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে নমিনেশন ফরম কিনে অথবা রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রতিনিধি হয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে জনগণের প্রতিনিধি হতে পারবেন।
দলীয় প্রতিনিধি মনোনীত হয়ে যিনি বা যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তার যোগ্যতা শুধু দলীয় আনুগত্য আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টাকা। নিম্নকক্ষের দলীয় প্রতিনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি, অভিজ্ঞতার আকাল আর দক্ষতার অভাব যখন জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করেছে, সেই ক্ষত সারানোর জন্যই উচ্চকক্ষের দাবি সামনে আসে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দলীয় প্রতিনিধির সমন্বয়ে নির্বাচিত নিম্নকক্ষ যেখানে সব দিক দিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচারে শীর্ষ স্থান দখল করছে, সেখানে একই শ্রেণির দলীয় প্রতিনিধি মনোনয়নের মাধ্যমে উচ্চকক্ষ গঠন কি কোনো সুফল আনবে?
বিদ্যমান দলীয় প্রতিনিধির সংসদীয় ব্যবস্থায় তাদের দোষত্রুটি, অপারগতা, অক্ষমতা, লোভলালসার কুফল আমাদের গোটা রাজনৈতিকব্যবস্থাকে জনগণের চোখে দুর্নীতিবাজ আর লুটপাটকারীর জোট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এমতাবস্থায় দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে দলীয় প্রতিনিধির উচ্চকক্ষ সংকটের সমাধান না করে কায়েমি স্বার্থের আরেকটি শ্রেণি সৃষ্টি করবে। দলীয় প্রতিনিধির উচ্চকক্ষের পরিবর্তে শ্রেণি-পেশার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে আপার হাউস প্রতিষ্ঠা করা হলে, দেশ ও জনগণের ভোগান্তি দূর হবে। সুশাসন কায়েম হবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হবে।
তা ছাড়া শ্রেণি, কর্ম ও পেশাজীবী প্রতিনিধির সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে আইন প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের মূল সমস্যা সংকটের স্বরূপ শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে বিদ্যমান সংসদীয় পন্থায় আমরা স্থানীয় সমস্যা ও সংকট অবগত হতে পারলেও কর্মজীবী ও পেশাজীবী মানুষের পেশাগত সমস্যা সম্পর্কে আমরা একেবারেই অনভিজ্ঞ। দেশের প্রত্যেক মানুষের ভৌগোলিক বা স্থানীয় সংকট-সম্ভাবনা আর কর্মক্ষেত্র বা পেশাগত জীবনের সংকট-সম্ভাবনা থাকে। আমাদের এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা শুধু স্থানীয় সমস্যার সমাধানে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ একজন নাগরিকের বিশাল পেশাগত জীবনের সমস্যা, সংকট-সম্ভাবনা সম্পর্কে তার বা তাদের ওয়াকেবহাল থাকার কথা নয়। কৃষকের মন্ত্রী কৃষক না হয়ে যদি একজন শিক্ষক হন, তার জানার কথা নয় যে ধান উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় কত। কত দামে বিক্রি করলে তার পুঁজি উঠবে। ধানগাছের পোকার আক্রমণে কোন কীটনাশক আমদানি করতে হবে বা উৎপাদন করতে হবে। শ্রমিকের মন্ত্রী যদি ব্যবসায়ী হন, আমলা হন অথবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হন, শ্রমিকের ঘামের গন্ধে কত দুঃখ লুকিয়ে আছেন তা কীভাবে অনুধাবন করবেন। তেমনি করে শিল্পের মালিক যদি শিল্পমন্ত্রী না হন তাহলে তিনি কীভাবে বুঝবেন আমাদের শিল্পের সমস্যা-সংকট কোথায়, সেই জন্যই শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবী মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে মূল সংকটের সুরাহার জন্য বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী উন্নত আইন-কানুন প্রণয়নের মাধ্যমে সংকট সমস্যা নিরসনের পন্থা উন্মুক্ত হবে। দলীয় প্রতিনিধির উচ্চকক্ষ নয়। শ্রেণি, কর্ম ও পেশার প্রতিনিধির উচ্চকক্ষই প্রত্যাশিত সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণ করবে। তা না হলে যেই লাউ সেই কদুই হবে।