Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

জলের তলে জালের আবাস

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৯

জলের তলে জালের আবাস

ইদানীং পরিচিত বলয়ে একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় আর তা হলো ইলিশ কিনে ঠকে যাওয়া। বাজারে অচেনা বিক্রেতার কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা কেজি মূল্যের ইলিশ কিনে, সেই ইলিশ খেতে গিয়েই ভোক্তা টের পাচ্ছে তাকে বহু দিনের পুরোনো, কোল্ড স্টোরেজে থাকা মাছ গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইলিশের মৌসুমেও চড়া দামে ইলিশ বিক্রি হওয়ার মূলে যতগুলো কারণ আছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। ভরা মৌসুমে টন টন ইলিশ মাছ বাজারে না ছেড়ে, অফ সিজনে প্রকারান্তরে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য কোল্ড স্টোরেজে স্টক করে রাখা হয়।

স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় মাছ অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা যে পরিমাণ প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করি, তার প্রায় ৮০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। এ ছাড়া জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ ও রপ্তানি আয়ের ১১ ভাগ আসে মাছ থেকে। দেশের প্রায় এক কোটি লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য আহরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এই মৎস্য প্রাধান্য খুবই স্বাভাবিক। কারণ এ দেশে রয়েছে উর্বর মাটি, অনুকূল জলবায়ু ও অসংখ্য বদ্ধ ও উন্মুক্ত জলাশয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় বঙ্গোপসাগরের ৩৫০ মাইল লম্বা সমুদ্র তট। 

বস্তুত শুধু পরিমাণেই নয়, প্রজাতির বৈচিত্র্যেও আমাদের খাদ্যতালিকা ও অর্থনীতিতে মাছের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশে শুধু অভ্যন্তরীণ জলাশয়েই ২৬০ থেকে ৫০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে, যা পুরো ইউরোপ মহাদেশের চেয়েও বেশি। খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনৈতিক জীবনেই নয়, মাছের প্রভাব আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অঙ্গনেও ছড়িয়ে আছে। মাছে-ভাতে বাঙালি-এই অতি পুরোনো প্রবাদ-প্রবচনের মধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের আদি পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে, ভগবান প্রথমে পৃথিবীতে আসেন মৎস্য অবতার রূপে। মহাভারতে অন্তর্ভুক্ত মৎস্যগন্ধার কাহিনিতে আছে মাছ আর মানুষের নিবিড় সম্পর্কের কথা। ইসলাম ধর্মে মাছের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ভাবেই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সুরা নাহলের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সমুদ্রকে, যেন তোমরা তা থেকে তাজা ও টাটকা মাছ খেতে পারো।’ মধ্যযুগের কবি কংকন চণ্ডী জেলের জীবনে দেখেছেন প্রশান্তির ছায়া। 

বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে চাষযোগ্য নয় বিধায় ইলিশের কদর সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী ইলিশের উৎপাদন কমার সঙ্গে সঙ্গে  বাংলাদেশেও এর উৎপাদন কমে চলেছে। ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। বাঙালির রসনা ও আত্মপরিচয়ের অনুষঙ্গ যে ইলিশ, তা আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে, ১৫ শতাংশ ভারতে ও ১০ শতাংশ মিয়ানমারে। বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই আসে ইলিশ প্রজাতি থেকে। উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা, গ্রামীণ বাজারের প্রাণচাঞ্চল্য এই ইলিশকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে একাধিক প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ।

প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে জলবায়ু পরিবর্তন। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে, যা ইলিশের প্রজনন ও বর্ধনের জন্য অনুকূল নয়। উজানের নদীগুলোর প্রবাহ কমে যাওয়া, বিশেষত শুকনা মৌসুমে, ইলিশের স্বাভাবিক মাইগ্রেশন বা চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার নাব্যতা কমে যাওয়ায় ও মেঘনার মোহনায় ডুবোচরের সংখ্যা বাড়ায় ইলিশের চলাচলের প্রধান পথগুলো সংকুচিত হচ্ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলের দূষণ, বিশেষত শিল্পবর্জ্য ও প্লাস্টিকের প্রভাব, ইলিশের আবাসস্থল ও খাদ্যশৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ ছাড়া আছে অতিরিক্ত আহরণ এবং জলের নিচে জালের সাম্রাজ্য। পানির নিচে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদী এবং সমুদ্র উপকূলে জাল বিছিয়ে রাখা হয় মাছ ধরার জন্য, যা পরিযায়ী মাছ ইলিশের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকাও ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তার পরও বছরে দেশে পাঁচ লাখ টনের বেশি  ইলিশ উৎপাদিত হয়। গত ২৩-২৪ অর্থবছরে যদিও আগের  বছরগুলোর  তুলনায় প্রায় ৪২ হাজার টন কম উৎপাদিত হয়েছে। শুধু সে কারণেই ইলিশ সাধারণের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে, এটা ঠিক নয়। এ দেশে এত বিশাল পরিমাণে ইলিশ উৎপাদিত এবং আহরিত হলেও তা কয়েক বছর ধরে গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থেকে যাওয়ার পেছনে কিছু অব্যবস্থাপনা ও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। 

বিগত সরকারের আমলে বিদেশে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়কে প্রধান করে দেখানো হয়েছে, তাই জাতীয় মাছ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হেঁসেলে ইলিশ পোলাওয়ের উৎসব সাধারণ জনগণ গণমাধ্যমে দেখলেও নিজেদের খাবার ঘরে তার আয়োজন করতে পারেনি। সরকার পরিবর্তনের পর গত আগস্টে মানুষ ভেবেছিল, এবার বুঝি ইলিশ এলো পাতের নাগালে। মৎস্য ও পশুসম্পদ উপদেষ্টা এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন যে, ইলিশ রপ্তানি হবে না, বা দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে হবে। কিন্তু এক অজানা কারণে জাতীয় মাছ আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। একটা খাদ্যপণ্য যা স্বদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়, সেটি স্বদেশি জনগণের রসনা পূরণ না করেই বিদেশে চলে যাওয়াটা কতটা সমীচীন কে জানে! এ ছাড়া ইলিশের দাম বৃদ্ধির আর একটি কারণ হলো এর বাণিজ্যিক মূল্য। ইলিশ একটি মাছ হিসেবে যতটা না, একে একটি অপরিহার্য পণ্য হিসেবে 

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা এর করপোরেট ভ্যালু বাড়িয়েছে। যে কারণে যখন ইলিশের মৌসুম না, তখনো ইলিশের উপযোগিতার কারণে কোল্ড স্টোরেজে এর মজুতদারি বেড়েছে। তাই যখন বাজারে ইলিশ কিনতে যাওয়া হয় তখন ক্রেতাকেও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয় না জানি ইলিশটা কত বছরের পুরোনো! কোল্ডস্টোরেজে থাকা ইলিশ কিনে ঠকে গিয়ে ক্রেতাকে আফসোস করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের যেন কোনো হেলদোল নেই। সরকার যদি এমন একটা নিয়ম করতে পারত যে, এক বা দুই মাসের বেশি কেউ ইলিশ মজুদ করে রাখতে পারবে না। এবং যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে যদি এর প্রয়োগ ঘটাতে পারত, তাহলে ইলিশের মৌসুমে অন্তত ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যেত না। যে যাই বলুক, ইলিশ বাঙালির অস্তিত্বের অংশ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাঙালি বছরে দু-একবার ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করবে না, তাই কি হয়! তাই জলের নিচে জালের সাম্রাজ্য ঠেকাতে না পারলেও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে জলের ওপরে অবৈধ মজুতদারি ঠেকানো তো যেতেই পারে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫