Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

দুর্গাপূজায় গণমানুষের আরাধনা

Icon

প্রণব চক্রবর্তী

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২

দুর্গাপূজায় গণমানুষের আরাধনা

দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। পূজা অনুষ্ঠানটি ধর্মীয় হলেও এর সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। দুর্গাপূজা যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আয়োজনের ক্ষেত্রে ছিল তখন থেকেই এর অবয়ব ছিল ব্যাপক। সমাজের নানা স্তরের, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ এর সুফল পেত পূজার আয়োজনে তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে। বছরের যে সময়ে সাধারণত গৃহস্থ বাড়িতে ফসলের ঘাটতি দেখা দিত, তখন পূজার কার্যক্রম শুরু হতো।

ব্যাষ্টিক অংশগ্রহণে এর মাত্রা ও সীমানা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। এককথায় দুর্গাপূজাকে এখন সম্মিলিত পূজা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ একালের বেশির ভাগ দুর্গাপূজার উদ্যোক্তা হচ্ছেন সোজা কথায় গণমানুষ। সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য বিম্বিত হয়ে ওঠে সমকালীন দুর্গোৎসবে, যা বয়ে নিয়ে আসে শুভ চেতনা। 

মার্কন্ডেয় পুরাণের মতে, চেদি রাজবংশের রাজা সুরথ খ্রিষ্ট জন্মের ৩০০ বছর  আগে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ প্রথম পূজা করে ৬০ হাজার বছর শান্তিতে রাজ্য শাসনের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তবে ১৭ শতকে বাংলার আঞ্চলিক প্রশাসকরা নিজেদের বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। তাদের অনেকেই ছিলেন রাজা উপাধিতে ভূষিত। তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন। তবে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গাপূজাকে করে তুলেছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলনের উৎসব।

শ্রীশ্রী চণ্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-

ঋষিরুবাচ ॥ ২৮

এবং স্তুতা সুরৈদিরবৈ কুসুমৈর্নন্দনোদ্ভবেঃ।

অর্চিতা জগতাং ধাতী তথা গন্ধানুলেপনৈঃ ॥ ২৯

মেধা ঋষি বললেনÑএভাবে জগন্মাতা দুর্গাকে সব দেবতারা মিলে স্তব করলেন এবং স্বর্গের নন্দন কাননের দিব্য পুষ্প এবং গন্ধচন্দনাদি দিয়ে তাঁকে পূজা করলেন। তারপর সকলে মিলে যখন ভক্তিভরে দিব্য ধুপসমূহের সুগন্ধ নিবেদন করলেন, তখন দেবী প্রসন্ন বদনে প্রণত দেবতাদের বললেন-

দেব্যুবাচ ।। ৩১

ব্রিয়তাং ত্রিদশাঃ সর্বে যদস্মত্তোহভিবাঞ্ছিতম।। ৩২

দেবী বললেন, হে দেবগণ! তোমরা সকলে আমার নিকট হতে তোমাদের অভিলষিত বর প্রার্থনা করো।।

সকলের অভিলষিত বর প্রার্থনার বিষয় মূলত সম্মিলিত প্রার্থনার বা উপাসনার উদ্যোগ। যেমন-সম্মিলিত এর প্রার্থনার প্রক্রিয়াও সম্মিলিত। আর তাই মর্ত্যরে দুর্গাপূজা সম্মিলিত আয়োজনে বিস্তৃত প্রার্থনার ছাপ গ্রহণ করেছে।

পূজা পরিণত হয়েছে মহাপূজায়। এতে সবার অবদান রয়েছে, রয়েছে এর পরিসীমা ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যোগসূত্র। বিত্তবানদের ঘর ছেড়ে পূজার বৃহত্তর পরিসরে অভিযাত্রা দিন দিন তাই বিস্তৃত হচ্ছে। এখন দু-একটি ক্ষেত্র ব্যতীত জাঁকজমকপূর্ণ পূজা অনুষ্ঠান বলতেই গণ উদ্যোগ বা সাধারণের উদ্যোগে পূজা বোঝায়। এটির প্রচলিত নাম সর্বজনীন দুর্গাপূজা।

সর্বজনীন পূজার শুরু ‘বারোয়ারি’ পূজা অনুষ্ঠান থেকে। বলা হয়ে থাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলির গুপ্তিপাড়ার ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে নিজেদের উদ্যোগে ১৭৬১ সালে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন। তারা নিজের চাঁদা দিয়ে পূজার সূচনা করলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন তাদের সহায়তায়। ১২ জন ইয়ার বা বন্ধুর এই উদ্যোগ ‘বারোয়ারি পূজা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ধনীদের চৌকাঠ অতিক্রম করে দুর্গাপূজা জনতার পূজা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে ‘বারোয়ারি’ শব্দটিও সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে।

দুর্গাপূজার এই সর্বজনীন রূপ এখন অন্যান্য সব পূজা-পার্বণে সমানভাবে লক্ষ করা যায়। কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাসোৎসব, সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজাসহ সব ধরনের পূজা অনুষ্ঠানে সর্বজনীন অংশগ্রহণ এখন প্রতিষ্ঠিত। কখনো কখনো একটি পরিবার দুই ধরনের আয়োজনেও অংশ নিয়ে থাকে। যেমন সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজা ইত্যাদি। বাড়িতে ব্যক্তি পর্যায়ে আয়োজিত পূজা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অনেকে বড় আঙ্গিকে আয়োজিত সর্বজনীন পূজায়ও অংশগ্রহণ করে থাকে।

সর্বজনীন অভিগম্যতা পূজার সৌকর্য ও বহুমাত্রিক আবেদন সৃষ্টিতে প্রকৃতার্থে ভূমিকা পালন করে থাকে। অবশ্য এর নেতিবাচক দিক যে একেবারে নেই তা নয়। ‘সর্বজনীন কমিটি’ নিয়ে দলাদলি বা বাদ-বিসম্বাদ কখনো কখনো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালেও সাধারণভাবে পূজা অনুষ্ঠান ব্যাহত হওয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটে না।

দুর্গাপূজার মূল বিষয় হচ্ছে শক্তির সম্মিলিত আরাধনা ও জনতার প্ররক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ। শ্রীশ্রী চণ্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ে ঐক্যবদ্ধ ভক্তদের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়-সব দেবতার শক্তিপুঞ্জের ঘনীভূত মূর্তি যে দেবী স্বীয় শক্তিতে সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন, সব দেবতা ও ঋষি পূজিতা সেই জগদম্বাকে আমরা ভক্তিপূর্বক প্রণাম করি। তিনি আমাদের মঙ্গল করুন। ভগবান শেষ নাগ, ব্রহ্মা ও শিব যার অনুপম প্রভাব ও শক্তির বর্ণনা করতে সক্ষম নন, সেই ভগবতী চণ্ডিকা সমগ্র জগৎ পালন ও অসুরভীতি নাশ করার জন্য ইচ্ছা করুন।

যিনি স্বয়ং পুণ্যবানদের ঘরে লক্ষ্মীরূপে, পাপীদের ঘরে দারিদ্র্যরূপে, শুদ্ধ অন্তকরণ ব্যক্তিদের হৃদয়ে শ্রদ্ধারূপে এবং সদবংশজাত মানুষের লজ্জারূপে নিবাস করেন, সেই ভগবতী দুর্গাকে আমরা প্রণাম করি। দেবী! আপনি এই সমগ্র বিশ্ব প্রতিপালন করুন।

দেবী! যার কৃপায় সকল শাস্ত্রের সার জানা যায়, সেই মেধাশক্তি আপনিই। আপনি দুর্গম ভবসাগর পার হওয়ার তরণী, দুর্গাদেবীও আপনিই। কোনো কিছুতেই আপনার আসক্তি নেই। ভগবান বিষ্ণুর বক্ষনিবাসিনী ভগবতী লক্ষ্মী এবং ভগবান চন্দ্রশেখরের দ্বারা সম্মানিতা দেবী ও আপনিই।

সদা অভীষ্টদায়িনী আপনি যাদের ওপর প্রসন্ন হন, তারা সর্বত্র সম্মানিত। তাদের ধন, যশ বৃদ্ধি পায়। তাদের ধর্মকর্ম কখনো হ্রাস পায় না এবং তারা আত্মীয়স্বজন স্ত্রী-পুত্র, ভ্রাত্যাদিসহ নিরাপদে থাকে এবং তারাই ধন্য।

পূজাতে গণমানুষের ঐকতানে ধ্বনিত হয় দুঃখ, দারিদ্র্য ও ভয়হারিণি। হে দেবী, আপনি ছাড়া অন্য আর কে আছে যে সবার মঙ্গলের জন্য সদাই দয়ার্দ্র থাকে। এটিই গণশক্তি ও সাহসের উৎস। 

গণমানুষ তাই নিজেদের শক্তিব্যূহ তৈরি করে এই পূজার মাধ্যমে। সমষ্টি যে আদিকাল থেকে বড় শক্তি তা সর্বজনীন সখ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জানা যায়। সর্বজনীন পূজা এ জন্য গণমানুষের ঐক্যের পূজা, সংহতির পূজা। ভ্রাতৃত্বের পূজা, সর্বোপরি গণমানুষের পূজা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫