
ডাকসু ও জাকসু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একচেটিয়া জয়ের পর রাজনৈতিক অঙ্গন, সুধীসমাজের আলোচনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের হিসাব কষা শুরু হয়ে গেছে-আগামী জাতীয় নির্বাচন অর্থাৎ ত্রয়োদশতম সংসদ নির্বাচনে জনগণ জয়মাল্য কার গলে পরাবে? বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত নাকি অন্য কারো গলে? জাতীয় নির্বাচনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রভাবই বা কতটুকু পড়বে এবং কীভাবে ক্রিয়াশীল হবে।
অনেকেই বলতে চাচ্ছেন, জাতীয় নির্বাচনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ বিষয় দুটি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাসের। আবার অনেকেই বলতে চাচ্ছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।
২০১৪ থেকে অদ্যাবধি দেশে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ভোটাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ। যদিও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ৫৪ বছর ধরে নির্বাচনকেই একমাত্র গণতন্ত্র হিসেবে মানুষকে বিশ্বাস করানোর নানাবিধ ফন্দিফিকির করে আসছে। তবে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র তো নির্বাচন নয়। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি শর্ত মাত্র। গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলো যেমন-আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, মানুষের সভা-সমাবেশের অধিকার, মানবাধিকার ও আরো মৌলিক কতক উপাদান নিয়ে গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকাশিত হয়।
আমরা অর্ধশতাব্দী ধরে এসবের কিছুই ভোগ করতে পারিনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষ যে বিষয়টি অনুধাবন করছে, সেটি হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে সরকার পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া, গণতন্ত্র না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামটা ছিল মূলত গণতন্ত্রেরই লড়াই। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ বানালাম। কিন্তু গণতন্ত্র পেলাম না। আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞার ছিটেফোঁটাও বাংলার মানুষ দেখা পায়নি। চব্বিশের গণজাগরণ জনগণকে একটা মৌলিক প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেছে যে, গণতন্ত্রে পৌঁছতে হলে আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। সেই করার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে যদি আমরা জাতীয় নির্বাচনের ট্রায়াল বলি, ভুল বলা হবে না। আমাদের সব পরিবর্তনের অগ্রসেনানী ছাত্ররাই ছিল এবং এখনো আছে। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ আর ২৪ সবই তো তাদের ত্যাগ, মেধা, সাহস আর দেশপ্রেমের গৌরব উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররাই মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ছাত্রদের হাতেই স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। ছাত্ররাই স্বাধীনতার মন্ত্রে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিপাগল করেছিল। ছাত্ররাই নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের অগ্রগামী প্লাটুন। চব্বিশের নজির তো আমাদের সামনেই আছে। আওয়ামী জোটের বাইরের ছোট-বড় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল যখন শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সময় পার করছিল, সাধারণ ছাত্ররা তখন কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানার ছাড়া কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হয়।
যদিও অভ্যুত্থানের শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে অস্বীকার করা যাবে না, ছাত্ররাই আমাদের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। আসাদ, আবু সাঈদ, মুগ্ধ, শ্রাবণ, দিপালী কাঞ্চন, মোজাম্মেলরাই হচ্ছে আমাদের সব লড়াই-সংগ্রামের সিঁড়ি। তাদের বলিদানই দেশের মানুষকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নিজের অধিকার আদায়ে লড়াই-সংগ্রামে উদ্বেলিত করেছিল।
এখন আসি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কতটুকু এবং কীভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে? সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল বা ইস্যুর পক্ষে মাঠে নেমেছে, সেই রাজনৈতিক দল পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ৬৯, ৭০ আর ৭১-এ অবিভক্ত ছাত্রলীগই অভ্যুত্থান, নির্বাচন আর স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে তাদের দাবি বা চাওয়ার পক্ষে উজ্জীবিত করতে রাজপথে আর মাঠে-ময়দানে অবিশ্রান্তভাবে পরিশ্রম করেছে। সেই দিনের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্যাগ, পরিশ্রম আর সাহস আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে অপরিসীম অবদান রেখেছিল।
৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভূমিকা সর্বাগ্রে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। অন্যান্য ছাত্রসংগঠনও তাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের দিক থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ছিল প্রথম সারিতে। ৯০-এর অভ্যুত্থানের পর ৯১-এর নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভূমিকার কারণেই জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতার দেখা পেয়েছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা হয়। সেই আন্দোলনে সাধারণ ছাত্ররাই মুখ্য ক্রীড়নক। এই সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রভাব লক্ষণীয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রশিবিরের যে জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাস দেখা যাচ্ছে, ততটা অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি নেই। ছাত্রশিবির বর্তমানে দেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার আসনে আছেন।
তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন ক্রমেই বাড়ছে। তাই জাতীয় নির্বাচনে সেই জনপ্রিয়তার সম্ভাবনাময়ী প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এখন দেখার পালা ইতিহাসে কারা নিজেদের নাম লেখায়।