শহীদ আবরার ফাহাদ যার জন্য জেতার স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ

শেখ খলিলুর রহমান
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:০৪

আবরার ফাহাদ
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত। সেই রাতে বুয়েটের হলে যেন মরে যায় বাংলাদেশ!
আবরার ফাহাদ একক কোনো ব্যক্তি নয়, কোটি কোটি বাংলাদেশির স্বাধীনতার প্রতীক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফল স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রধান শর্ত সার্বভৌমত্ব। আর সার্বভৌমত্বের ভ্যানগার্ড হয়ে ওঠেন আবরার ফাহাদ। যার শক্তি অনুমান করা যায় জুলাই গণবিস্ফোরণে। জুলাইয়ের তরুণবক্ষে, তাদের নিঃশ্বাসে প্রতিধ্বনিত নামটিই আবরার ফাহাদ।
তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ প্রমাণ করে ভারতীয় আধিপত্যের পক্ষে কাজ করেছে।
নইলে বাংলাদেশপন্থি এবং দেশের স্বার্থের পক্ষে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্যে তাকে হলের রুমে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলত না। নিশ্চয়ই ওপরের নেতৃস্থানীয় আপা-ভাইদের ইশারা ছিল। যারা প্রকাশ্যে বলেছেন, ভারতের প্রতি নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার কথা। বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছেন তা আজীবন মনে রাখার কথা। দুই দেশের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা। তার হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দেয়, গত ১৬ বছর কার উদ্দেশ্য সাধন করেছে পতিত স্বৈরাচার ও তার বহরের সঙ্গীরা।
আবরারের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশপন্থিদের জন্য ছিল একটা ধাক্কা। বজ্রপাত। আবরারের হত্যাকাণ্ডই প্রথমবারের মতো মনে করিয়ে দেয়, লীগের হাতে বাংলাদেশপন্থিরা কতটা অনিরাপদ। শুধু সন্দেহ হলেই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কাউকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলতে পারবে। আবরারই প্রথমবারের মতো আমাদের বুঝিয়ে দেয়-পতাকা, জাতীয় সংগীত বা সংবিধান প্রকৃত স্বাধীনতা দেয় না। প্রকৃত স্বাধীনতা আসে শাসকের কাছ থেকে। গণতান্ত্রিক শাসক হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে।
আবরারের হত্যাকাণ্ড বিবেকবানদের বুঝিয়ে দেয়, পিন্ডির থেকে স্বাধীন হলেও দিল্লির থেকে স্বাধীন নয় সার্বভৌম বাংলাদেশ। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েও বেঁচে থাকতে পেরেছিলেন! কিন্তু আবরার ফেনী নদীর পানি চেয়ে আর বেঁচে থাকতে পারলেন না।
তারপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ভয়ংকর সংগঠন হিসেবে অনুধাবন করল। রীতিমতো ঘৃণা করতে শুরু করল। যার চূড়ান্ত ফলাফল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেখা গেছে।
আবরার ফাহাদ আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটা বক্তব্যের মর্ম বুঝেছিলেন। খালেদা জিয়া একবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওদের হাতে আছে গোলামির জিঞ্জির আর আমাদের হাতে আছে স্বাধীনতার পতাকা।’ আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর মনে হয়, এই গোলামের দল ক্ষমতায় না থাকলে কি আবরার ফাহাদকে এভাবে জীবন দিতে হতো?
আবরার নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অনেকের দেহে রাজনৈতিক প্রাণ সঞ্চার করে গেছেন। বাংলাদেশপন্থিদের জাগিয়ে দিয়ে গেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন একাত্তরের ভিত গড়ে দিয়েছিল, উনিশের আবরারও তাই। পাকিস্তান সরকার যেমন শহীদ মিনার ভেঙে দিত, হাসিনার বাহিনীও আবরারের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দিয়েছে বারবার। কিন্তু আবরার থেকে যায় সংগ্রামীদের স্মরণে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ আর আওয়ামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আবরার এক বড় মহাকাব্য। এই যে জুলাই বিপ্লবে দুই হাজার আবু সাঈদ আর ওয়াসিমরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনলেন, ওই শাহাদাতের দুর্গম পথটা শহীদ আবরারের রক্তেই প্রথম লাল হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অসম চুক্তি এবং পানি আগ্রাসন নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসের জেরে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নৃশংস কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করে বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠনটির ক্যাডাররা। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফুঁসে ওঠেন বুয়েটসহ অন্য শিক্ষার্থীরা। গণ-আন্দোলনে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয় ছাত্ররাজনীতি।
অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হলেও স্বভাবতই প্রযুক্তির জ্ঞান থাকা বুয়েটের প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। ওই রাতের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংবলিত ল্যাপটপ পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন বুদ্ধিমান প্রতিবাদীরা। এটিই হয়ে ওঠে ভারতীয় আধিপত্যের পক্ষে কাজ করা বর্বর ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করার বড় হাতিয়ার। সেই ফুটেজ দেখেই ফুঁসে ওঠে সবাই।
শহীদ আবরার ফাহাদ আমাদের সার্বভৌমত্ব ও আগ্রাসন বিরোধী প্রতীক। তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুটি জিনিস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। একটি হলো আওয়ামী লীগের নির্যাতন, অন্যটি ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশপন্থিদের সংগ্রাম। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ৫৪ বছর ধরে যে সংগ্রাম চলছে, আবরার ফাহাদের শহীদ হওয়ার ঘটনা এই সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট।
শহীদ আবরার ফাহাদ একজন অসামান্য সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। বুয়েটে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মুক্ত চিন্তার চর্চা করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আবরার যখন কাঁদছিলেন, তখন খুনিদের একটুও কষ্ট হয়নি। তারা নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে তাকে। আবরার ফাহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসিকতার প্রতীক। তার আদর্শ আলোকিত করে। ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেয় মানুষকে।
দীর্ঘ নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, খুনের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রতিবাদের পর আবরার ফাহাদের শাহাদাত গোটা জাতিকে ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। বিরোধী মতাদর্শ লালন করলেই হত্যা করার যে বৈধতা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ উৎপাদন করেছিল, তা ক্রমে প্রতিরোধের মুখে পড়ে আবরারের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আধিপত্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে চলমান এ লড়াই এক নতুন মাত্রা পায়। ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী এই লড়াইয়ের পূর্ণতা আসে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে; শহীদ আবু সাঈদ, শান্ত, মুগ্ধ, ওয়াসিম, রিয়া গোপদের তাজা প্রাণ উৎসর্গের মধ্য দিয়ে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে গণরুম, গেস্টরুম কালচার ছিল, সেই অপশাসন, অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি যেন ফিরে না আসে শিক্ষাঙ্গনে, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনে আবরারের মতো আর কেউ খুন না হোক। আর কোনো মায়ের বুক খালি না হোক। নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করার মতো নিরাপদ ও সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন তৈরি হোক। মুক্ত চিন্তার সুযোগ থাকুক। বাংলাদেশপন্থার ঐক্যের স্বার্থে ভিন্নমতের চর্চা চলুক। কিন্তু ভিন্নমতের কারণে কাউকে যেন পিটিয়ে হত্যা করা না হয়-আবরার ফাহাদের শাহাদাতবার্ষিকীতে এটাই চাওয়া।
লেখক : সাংবাদিক