Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ভেনেজুয়েলায় অশান্তির জন্য ‘পাপেট নেতা’ মাচাদোকে শান্তি পুরস্কার

Icon

জাহেদ সরওয়ার

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:০৯

ভেনেজুয়েলায় অশান্তির জন্য ‘পাপেট নেতা’ মাচাদোকে শান্তি পুরস্কার

ভেনেজুয়েলার মুক্তিকামী মানুষের নেতা হুগো চাভেজের লড়াই জগদ্বিধিত। যিনি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অনন্য এক ভেনেজুয়েলাকে চিনিয়েছিলেন বিশ্বের কাছে। বই লিখে হুগো চাভেজের কর্মকাণ্ডের বিবরণ শেষ করা যাবে না। ভেনেজুয়েলার প্রতিটি সেক্টরে তিনি পরিবর্তন এনেছিলেন। শুধু ভেনেজুয়েলাই বা কেন, পুরো লাতিন আমেরিকায় তিনি মুক্তির দিশারী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। জাতিসংঘের ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রকে ‘শয়তান’ বলে ডেকেছিলেন চাভেজ।

সেই হুগো চাভেজের সাজানো ভেনেজুয়েলা এখন অশান্ত। যদিও বর্তমান শাসক নিকোলাস মাদুরো চাভেজের অনুসারী। কিন্তু চাভেজের মতো ডিপ্লোম্যাট নেতৃত্বের অভাব রয়েছে মাদুরোর মধ্যে। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো নেই, ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজ নেই। তাই লাতিন আমেরিকাজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নানাভাবে উপস্থিত।

ভেনেজুয়েলা তেল উৎপাদনে আরব বিশ্বের চেয়ে এগিয়ে অথচ দেশটির সিংহভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখানে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় স্বার্থ। মাদুরো ‘চাভেজপন্থি’ তথা ‘ভেনেজুয়েলাপন্থি’ হওয়ার কারণে সেখানে এখনো বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না তেলখোর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আর তাই মাদুরোকে উৎখাত করার জন্য তথা ভেনেজুয়েলাকে চাভেজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নিতে দেশটিতে নানাভাবে তৎপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।

যেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ প্রবল সেখানে তারা বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করে তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে। সেখানে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী বর্তমান অবস্থার পরিপন্থি ‘পাপেট’ নেতা তৈরি করে। তাদের নেতা বানাতে মিডিয়ায় বিনিয়োগ হয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ভেনেজুয়েলায় তেমনই এক সাম্রাজ্যবাদের পাপেট নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো এবার শান্তিতে নোবেলজয়ী। যিনি চাভেজ তথা ভেনেজুয়েলার স্বার্থবিরোধী। তিনি এখন মাদুরোবিরোধী মার্কিন সমর্থিত ‘পাপেট’ নেতা। তার কর্মকাণ্ড, তার দৃষ্টিভঙ্গি সব সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থানুকূল। ভেনেজুয়েলায় অশান্তি সৃষ্টির পুরস্কার হিসেবে মাচাদোকে দেওয়া হলো নোবেল শান্তি পুরস্কার। মাচাদো তার এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পকে। নোবেল পুরস্কার আবারও প্রমাণ করল, সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিব্যবস্থার বাহক তারা। তাই বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের ভেতর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণার প্রলেপ তৈরি হলো।

সারাবিশ্ব যখন ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে উত্তাল। ইসরায়েলি সহিংস বর্বরতার বিরুদ্ধে যখন ফুঁসে উঠেছে বিশ্বের বিবেকবানরা। সেখানে গাজা ধ্বংসের খলনায়ক বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে মাচাদো বলেছেন, তিনি যেন বোমা মেরে ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করেন। তিনি নিজের দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন; অথচ তিনি জানেন, অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা নীরব যুদ্ধেরই রূপান্তর।

নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে গিয়ে ৭০ হাজার সাধারণ বেসামরিক নাগরিককে প্রকাশ্যে, কোনো মানবাধিকারের ধার না ধরে হত্যা করেছেন। মানে একই কাজ নেতানিয়াহুকে করতে আহ্বান জানিয়েছেন মাচাদো। তার জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তার কাজ হচ্ছে বিভেদ তৈরি করে ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্ব ক্ষয় করা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া।

মাচাদো ২০০২ সালের এমন এক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে অল্প সময়ের জন্য উৎখাত করেছিল। তিনি ‘কারমোনা ডিক্রি’তে স্বাক্ষর করেছিলেন, যা কিনা রাতারাতি সংবিধান বিলুপ্ত ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছিল। তিনি ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘রেজিম চেঞ্জ’কে ন্যায্যতা দিতে কাজ করেছেন। তিনি বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ‘বলপ্রয়োগের মাধ্যমে’ ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করা যায়।

ট্রাম্পের আগ্রাসি বক্তব্য ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত ‘মাদকবিরোধী অভিযানের’ নামে এক সম্ভাব্য আঞ্চলিক যুদ্ধের ইন্ধন জুগিয়েছে, মাচাদো সেই বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। পক্ষান্তরে মাচাদো ও ওয়াশিংটনের যৌথ পরিকল্পনায় তা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যখন ভেনেজুয়েলার সম্পদ জব্দ করছিল, তখন মাচাদো ছিলেন তার স্থানীয় সহযোগী। যিনি দেশের সার্বভৌমত্ব বিদেশি শক্তির হাতে সমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ভালো করেই জানতেন এই নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে গরিব, অসুস্থ ও শ্রমজীবী মানুষকে। ওষুধের অভাবে হাসপাতালে শিশুরা মারা যাবে, খাদ্যের সংকটে লাখো মানুষ অনাহারে ভুগবে-সব জেনেও তিনি সেই নীতির অংশ হয়েছিলেন।

মাচাদো ছিলেন সেই তথাকথিত ‘অন্তর্বর্তী সরকার’-এর অন্যতম মুখ্য স্থপতি যে সরকার আসলে ওয়াশিংটনের অর্থে পরিচালিত এক পুতুল প্রশাসন, যার স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট বিদেশে বিলাসবহুল জীবনে মত্ত ছিলেন আর দেশে জনগণ নিঃস্ব হয়ে পড়ছিল। ভেনেজুয়েলার সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছিল, অথচ শিশুরা তখন খাবারের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছিল। মাচাদো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তিনি জেরুজালেমে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস পুনরায় খুলবেন। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াবেন, যারা আত্মরক্ষার নামে হাসপাতাল ও স্কুলে বোমা ফেলে। তার পরিকল্পনা স্পষ্ট-দেশের তেল, পানি ও অবকাঠামো বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া-একই নব্য-উদারনৈতিক ফর্মুলা, যা নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকাকে দুঃখের পরীক্ষাগারে পরিণত করেছিল।

২০১৪ সালের ‘লা সালিদা’ আন্দোলনে মাচাদো ছিলেন অন্যতম স্থপতি। আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সরকার পতন-বিদেশি গণমাধ্যম একে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ’ বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ছিল সহিংস অরাজকতা। রাস্তা অবরোধ, সরকারি ভবন ও শ্রমিকবাহী বাসে আগুন, খাদ্যবাহী ট্রাক ধ্বংস, স্কুল ও হাসপাতাল পুড়িয়ে দেওয়া-এসব ছিল দৈনন্দিন দৃশ্য। চাভেজের সমর্থক বলে সন্দেহ হলেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স এমনকি কিউবার চিকিৎসা ব্রিগেডও রেহাই পায়নি। আর এই সহিংসতা, এই ধ্বংসযজ্ঞ-সবকিছুকেই মাচাদো টেলিভিশনে দাঁড়িয়ে ‘প্রতিরোধ’ বলে তকমা দিয়েছেন।

ট্রাম্প যখন অভিবাসী শিশুদের খাঁচায় বন্দি করেছিলেন, হাজারো পরিবারকে আলাদা করে দিয়েছিলেন, তখন মাচাদো সেই অমানবিক নীতিকে বলেছিলেন, ‘দৃঢ় পদক্ষেপ’। আজ সেই নীতির ফলে ভেনেজুয়েলার রাস্তায় অসংখ্য মা তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে ফিরছেন। এই হলো সেই মাচাদো, যাকে আজ শান্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

আসলে মাচাদো শান্তির প্রতীক নন। তিনি বৈশ্বিক এক জোটের অংশ, যেখানে ফ্যাসিবাদ, জায়নবাদ ও নব্য-উদারনীতি (নিওলিবারালিজম) জড়িত। তথা তিনি করপোরেটক্রেসির একজন মাইনে করা রেজিম চেঞ্জার হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি একদিকে পলিটিক্যাল, অন্যদিকে ইকোনমিক্যাল হিটম্যান। এমন একজন অমানবিক নেতাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া এই মুহূর্তে অস্বাভাবিক না।

গোটা দুনিয়া এখন এই করপোরেটক্রেসির হাতের তালুতে বন্দি। এই করপোরেটক্রেসি এতদিন ফিলিস্তিনকে নিতে ইসরায়েলকে দিয়ে নিরপরাধ মানুষ ও তাদের স্থাপনার ওপর বিলিয়ন টন বোমা ফেলেছেন। শিশু, নারী আর সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের ওপর টনকে টন বোমা ফেলে এবার করপোরেটক্রেসির অস্ত্র ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা হয়েছে নিশ্চয়ই। সে খুশিতেই কি মাচাদোর এই শান্তির অসুর পুরস্কার?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫