Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

বাড়ছে ছোট গাড়ি, সঙ্গে যানজট

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৫

বাড়ছে ছোট গাড়ি, সঙ্গে যানজট

ঢাকার গণপরিবহন বলতে বাসকেই বোঝায়। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যেতে একমাত্র ভরসা বাস। কিন্তু এত মানুষ নির্ভরশীল হওয়ার পরও বাসের দিকে তাকালে হতাশ হতে হয়। রাস্তায় বের হলে ছাল-বাকল ওঠা বহু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় জীর্ণ বাস চোখে পড়বেই। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষকে এসব  বাসেই চড়তে হয়, গন্তব্যে যেতে হয়। বাসের ভাড়াও যে কম তা নয়, তবুও অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে বাসে অপেক্ষাকৃত খরচ কম। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে চালু-এসবের সঙ্গে ঢাকার বাসের হালহকিকত কতটা মানানসই এটা একবার ভেবে দেখা দরকার। দেশের সিংহভাগ মানুষ চলাচলের পরিবহনের এই দুরবস্থা কোনোভাবেই মানানসই নয়। সকাল-বিকাল অফিসে যাওয়া-আসার সময় চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশে হাজারও মানুষের গাড়ির জন্য অপেক্ষা। একটা গাড়ি এলে সবাই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এত চাহিদা থাকার পরও সড়কে বাসের উপস্থিতি ক্রমে কমছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে সাশ্রয়ী বলেই বাসের জন্য মানুষের এত অপেক্ষা। তবে ঢাকার বাস নিয়ে বলতে গেলে সে আরেক বিড়ম্বনা। কারণ বাসের পরিচালনাব্যবস্থাই ত্রুটিপূর্ণ। সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ছয় হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এসব বাসের মালিক দুই হাজারের বেশি। মালিকেরা বেশি আয়ের আশায় চুক্তিতে চালকের হাতে বাস ছেড়ে দেন। বাস-মিনিবাসের মালিকদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক নেতা, কর্মী বা প্রভাবশালী ব্যক্তি। ফলে তাদের ওপর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ইচ্ছামতো বাস পরিচালনা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি সবারই জানা। বিপুল চাঁদাবাজির কারণে পরিবহনের মালিকরা বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। যেটা জনগণের উপরে পড়ে। 

এবারে বাসের আকার প্রসঙ্গে বললে দেখা যাবে সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে চালকেরসহ একটি বড় বাসে আসন থাকবে ৫২টি। মিনিবাসের আসনসংখ্যা হবে ৩১। সম্প্রতি বাস ও মিনিবাসের মাঝামাঝি আকারের বাস চলছে, সেগুলোকে বড় বাস হিসেবেই নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ, যার আসনসংখ্যা ৩৬ থেকে ৩৮টি। সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩১ আসনের মিনিবাসে ৩৬ থেকে ৪০টি পর্যন্ত আসন বসানো হয়; আর ৩৬ আসনের বাসে ৪০ থেকে ৪৫টি আসন থাকে। বড় বাসের আসনসংখ্যা ৬০টিতে গিয়ে ঠেকেছে। এটি পুরোপুরি আইনের লঙ্ঘন। এরপর বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে উঠেও যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা অনুসারে, প্রতিটি বাসে যাত্রীর জন্য অন্তত ১৬ বর্গ ইঞ্চি বসার জায়গা রাখতে হবে। বাসের আকৃতি পরিবর্তন করে বেশি সিট যুক্ত করায় যাত্রীকে চাপাচাপি করে বসতে হয়। বাসের আকৃতি পরিবর্তন কিংবা যাত্রীদের স্বচ্ছন্দ ঠিক আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। সংস্থাটি দায়িত্ব পালন করছে বলে কখনই মনে হয়নি। 

ব্যয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রতিটি বাস বা মিনিবাস নতুন করে সাজসজ্জার জন্য (রেনোভেশন) খরচ ধরা হয় সাড়ে ছয় লাখ টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হলো ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে বাস কিনে প্রায় সাত লাখ টাকা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের পরও বাসের এই করুণদশা কেন? পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ভাষ্য হলো জ্বালানি কেনা, ইঞ্জিন ও চাকা পরিবর্তন ছাড়া ঢাকার বাসের তেমন কোনো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। কোনো রকমে বাস চালাতে যেটুকু মেরামত দরকার, মালিকরা ততটুকুই করেন। তার পরও বাসের ভেতরের পরিবেশ যাত্রী চলাচলের উপযোগী নয়। বেশির ভাগ সময় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা হয়। বাসের পাদানি ও দরজায় ঝুলিয়ে যাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবার চোখের সামনে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অনিয়ম ও মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে চলছে বাসগুলো। ৬২ শতাংশ যাত্রী মনে করেন, বাসের ভেতরের স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে যাত্রীরা অখুশি। তবু চলতে হয় বলেই বাসে চড়া।

বাস সার্ভিসের এই দুরবস্থার কারণে সড়কে বাড়ছে ছোট ছোট পরিবহনের সংখ্যা। প্রাইভেট কার, ব্যাটারিচালিত রিকশায় ঠাসা এখন ঢাকা শহর। এ কারণে রাজধানীতে তীব্র যানজট বেড়েই চলছে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে শহরবাসীর কর্মজীবনে। প্রতিদিনই দুর্বিষহ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। শহরের মোড়ে মোড়ে সড়কের অব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন সংকট, প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও রিকশার মতো ছোটগাড়িগুলো তীব্র যানজটকে তীব্রতর করে তুলছে। শহরের ফার্মগেট, শাহবাগ, মহাখালী, মগবাজার, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, আসাদগেট, শ্যামলী, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, কাকরাইল, মৌচাক, বাড্ডা, রামপুরা, কারওয়ান বাজার ও নিউমার্কেট রুটে এই দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। এসব রুটে গণপরিবহন কমে ব্যক্তিগত পরিবহন বৃদ্ধিকে তীব্র যানজট সৃষ্টির কারণ হিসেবে দায়ী করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। 

বর্তমানে ঢাকার ১১০ রুটে মাত্র সাড়ে চার হাজার যানবাহন রয়েছে, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ঢাকা মহানগরীতে মোট ৮৯৩টি বাস-মিনিবাস নিবন্ধিত হয়েছে। ২০২৩ সালে এক হাজার ৮৮৭টি এবং ২০২২ সালে নিবন্ধিত হয়েছে দুই হাজার ২৩৩টি বাস-মিনিবাস। সড়ক বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বলেছেন, ঢাকায় মোট সড়কের প্রায় ৫০ শতাংশজুড়েই চলাচল করে ব্যক্তিগত গাড়ি, অথচ এগুলো বহন করে মাত্র ১২ শতাংশ যাত্রী। কিন্তু ৫০ শতাংশ বড় বাসে প্রায় ৮৮ শতাংশ যাত্রী পরিবহন সম্ভব। নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর নেই। এটি বাস্তবায়ন হলে সড়কে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য, উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়া, ঢাকা জেলার নিবন্ধিত অটোরিকশা মহানগরের ভেতর চলাচল, দিনের বেলায় পণ্যবাহী যান চলাচল, অপরিকল্পিতভাবে নানা দাবিতে বিভিন্ন সড়ক অবরোধ, সড়ক ব্যবহারকারীদের আইন না মানা ইত্যাদি কারণে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এর পরও খোলা চোখে তাকালে দেখা যায়, যেকোনো রাস্তার ৫০ ভাগ গাড়ি পার্কিংয়ে আটকে আছে। গতিশীল গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে কম গতির রিকশা থেকে ঠেলাগাড়ি। এভাবে চললে যানজট বাঁধবেই। তা ছাড়া নগরীর অনেক রুটে পর্যাপ্ত বাস নেই। সেখানে জায়গা করছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। আইন-কানুন-লাইসেন্স কোনো কিছুর বালাই নেই। এ রকম হাজারটা অনিয়মের মধ্যে চলছে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা। কোনো সমস্যারই সমাধান দেখা যাচ্ছে না। 

বিশ্বের অনেক শহরে এখন ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কোনো কোনো শহরে সপ্তাহের এক বা দুই দিন ব্যক্তিগত যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ঢেলে সাজানো হচ্ছে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা। পাশাপাশি কম দূরত্বের গন্তব্যে হাঁটা, সাইকেল প্রভৃতি উৎসাহিত করা হচ্ছে। 

সময়ের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। স্বভাবতই সচ্ছল অনেক পরিবারই কিনছে একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি। এসব গাড়ি কিনতে আয়ের উৎস জানা যেমন সহজ নয়, তেমনি প্রাইভেট কার নীতিমালা করারও আগ্রহ এই রাষ্ট্রের নেই। দেশের নানা ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হলেও ঢাকায় গণপরিবহনের অপ্রতুলতা একটা বড় সমস্যা হিসেবে রয়েই গেছে। অন্যদিকে শহরে বর্তমানে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন অবকাঠামো বাস্তবায়ন হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যানজট কমানো এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলেও তাতে বরং ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা হচ্ছে বেশি। মানুষ নতুন নতুন গাড়ি কেনায় উৎসাহিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে শহরে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ও ব্যবহার। যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও রাস্তার পরিসর বাড়ছে না, বরং বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে তা আরো সংকুচিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন যানজট অসহনীয় হয়ে উঠছে। যানজট কমাতে বরাবরই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ তাদের। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫