Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

হাসিনার পতনের মূল কারণ এড়িয়ে গেছে দিল্লি

Icon

শেখ খলিলুর রহমান

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৪

হাসিনার পতনের মূল কারণ এড়িয়ে গেছে দিল্লি

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসনের পতনের জন্য বাংলাদেশের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোকে দায়ী করে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী নেতাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে নয়াদিল্লির ধারাবাহিক সমর্থনের বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।

৩১ অক্টোবর ভারতের জাতীয় ঐক্য দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দোভাল বলেন, ‘একটি দুর্বল শাসন কাঠামো প্রায়ই সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশীয় দেশে এই ধরনের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অনানুষ্ঠানিকভাবে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।’

তবুও তিনি জেনারেশন জেড-এর (জেন-জি) নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করেননি, যা হাসিনার পতনের কারণ হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে, নয়াদিল্লি গণতন্ত্র প্রচারের আড়ালে প্রতিবেশী দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সমর্থন করে আসছে, যদি তারা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। মোদী প্রশাসনের বিশ্বস্ত এই সহযোগী স্বীকার করেননি যে এই নীতি কীভাবে এই অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিয়েছে।

দোভালের ব্যাখ্যায় হাসিনার পতনের কারণ ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থা, কিন্তু বাস্তবে তার শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশের প্রশাসনিক উপাদানগুলোকে পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণাধীন একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত করেছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নিরাপত্তা সংস্থা, সাংবিধানিক সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবই তার স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থনকারী অনুগতদের দ্বারা পরিচালিত হতো। নাগরিকদের ভোটাধিকার পদদলিত করে এবং জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত ও বিচারিক হত্যার মাধ্যমে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করার পরও দিল্লি এই (শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন) ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রেখেছিল।

সেই সময়ে, ভারত জোর দিয়ে বলেছিল যে বাংলাদেশের নির্বাচন একটি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। তবুও ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে (যা বিরোধী দল বর্জন করেছিল এবং ১৫০ জনেরও বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি তৈরি করেছিল) দিল্লি তার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠায়। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সুজাতা তৎকালীন জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, ‘গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির উত্থান রোধ করার অজুহাতে’ তাকে নির্বাচনে যোগ দিতে রাজি করানোর জন্য। এরশাদ যখন প্রথমে রাজি হননি, তখন তাকে ‘বিশেষ ব্যবস্থার’ মাধ্যমে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল।

হাসিনার পতন এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নয়াদিল্লি বাংলাদেশে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের জন্য প্রকাশ্যে কথা বলা শুরু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং এবং বাংলাদেশি সাংবাদিকদের একটি অংশের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর, এই বার্তার নতুন ধারাটিকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।

তবে হাসিনার পতন যে শেষ পর্যন্ত একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই হয়েছে, তা নিয়ে দোভাল কোনো কথা বলেননি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে আশাবাদী বিশ্লেষকরা বলেন,  হাসিনার অহংকার, একগুঁয়েমি ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, তার শাসনামলে রেকর্ডসংখ্যক গুম, দুর্নীতি, ব্যাপক অর্থ পাচার, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ধ্বংস, বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তির (যা নির্বাচনকে অর্থহীন করে তুলেছিল) মতো নানা ঘটনায় জনমনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। যার ফলস্বরূপ জুলাই অভ্যুত্থান ঘটে আর এর মাধ্যমেই তার পতন হয়।

হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন তাকে জনগণের কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলে তিনি নিজেকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রমে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেখ হাসিনা তার অপসারণের সব গণতান্ত্রিক পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন যে কেবল ‘হত্যা’ করেই তাকে পদ থেকে সরানো সম্ভব। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থি, বাংলাদেশপন্থি জনগণই রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

জাতিসংঘের একটি তথ্য অনুসন্ধান মিশনের মতে, ছাত্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে হাসিনার নৃশংস বল প্রয়োগের ফলে এক হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ২০ হাজারেরও বেশি লোক তাদের চোখ বা অঙ্গ হারায়।

বছরের পর বছর ধরে দমন-পীড়ন জনসাধারণের ক্ষোভকে আরো তীব্র করে তুলেছিল। ভোটাধিকার বঞ্চিত করা, স্থানীয় দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ব্যাপক অর্থ পাচারÑএসবই জনসাধারণের ক্ষোভকে আরো গভীর করে তুলেছিল। রাজনৈতিকভাবে, হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং এর ১৪ দলীয় জোট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, কারণ প্রায় প্রতিটি দল তার শাসনের বিরুদ্ধে ছিল। এর পরও দিল্লি দৃঢ়ভাবে তার পক্ষে ছিল।

ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, হাসিনার শাসনামল টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে টিকে থাকতে পেরেছিল মূলত ভারতের সমর্থন, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে একটি সতর্ক ভারসাম্য বজায় রেখে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়ে এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা আরো তীব্র হয়। ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ দেশের যুব ও সাধারণ মানুষকে হাসিনা এবং তার দলের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে ঠেলে দেয়, যার ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দিল্লির সমর্থনে তারা বাংলাদেশের কষ্টার্জিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আজ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি এবং দলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে-এই ভূমিকাটি দোভাল স্বীকার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সুশাসন সম্পর্কে দিল্লির সাম্প্রতিক বক্তব্যে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়। কারণ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপজুড়ে তরুণদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ঢেউ শিগগিরই ভারতে পৌঁছাতে পারে।

মোদী সরকারের ভেতরকার মহল, যার মধ্যে দোভালও রয়েছেন, তারা স্বীকার করেছেন যে ক্রমবর্ধমান অস্থির এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন প্রজন্মকে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ‘আফিম’ স্থায়ীভাবে শান্ত করতে পারে না। মোদীর প্রশংসা করে দোভাল মন্তব্য করেছেন, ‘আজকের মানুষ আরো সচেতন ও উচ্চাকাক্সক্ষী। রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি।’

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালজুড়ে তরুণদের বিদ্রোহের উত্থান সাক্ষী হয়ে অজিত দোভাল ও ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অন্যরা এখন নতুন সতর্কীকরণ জারি করছেন। এদিকে ভারতের বিরোধী দলগুলো গণতান্ত্রিক দাবির সমর্থনে রাস্তায় আন্দোলনে একই যুব শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য একত্রিত হচ্ছে।

এর মধ্যে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে-দক্ষিণ ভারতীয় সুপারস্টার থালাপতি বিজয়। দীর্ঘকাল ধরে সিনেমায় রাজত্ব করার পর তিনি এখন রাজনৈতিক মঞ্চে পা রেখেছেন, হিন্দুত্ববাদী প্রতিষ্ঠান ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠেছেন। বিশাল ভক্তদের সমর্থনে বিজয় নির্বাচনী রণক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন; নিজেকে পর্দার নায়ক থেকে জনগণের নায়কে রূপান্তরিত করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তরুণদের সক্রিয়তার ঢেউ দেখে ভারতের শাসকগোষ্ঠী এখন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধ ও পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে। দোভাল ও অন্যরা ‘অখণ্ড ভারত’ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য নরম করেছেন এবং এখন অভ্যন্তরীণ সুশাসনের বিষয়ে আরো বেশি কথা বলছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫