Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

কার নিরাপত্তায় ডিজিটাল আইন?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২০, ০৮:৪২

কার নিরাপত্তায় ডিজিটাল আইন?

করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলারও মহামারি শুরু হয়েছে। এ সময়ে দেশে আর কোনো আইনের এমন প্রয়োগ দেখা যায়নি। আইনটি পাসের পর সরকারের তরফে বরাবরই বলা হয়েছিল, এই আইনে সাংবাদিকরা টার্গেট নন বা সাংবাদিকরা এই আইনের ভিকটিম হবেন না; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর এই বিতর্কিত আইনে যত লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক, আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

শুধু ডিজিটাল আইনের মামলায় গ্রেফতারেই শেষ নয়; রাজশাহী এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। ফলে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে বা শুরু থেকেই জনমনে খুব জোরালোভাবেই ছিল, তা হলো- কার নিরাপত্তায় ডিজিটাল আইন?

আইনজীবী-সাংবাদিক-অ্যাকটিভিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, এই আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তার কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক তার সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারছেন এবং এ আইনের এমনই জাদুকরী ক্ষমতা যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। আবার গ্রেফতার হলে সহজে তার জামিনও হয় না। তার মানে, এই আইনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’র বিষযয়টি অস্পষ্ট রাখার কারণে যে কোনো সময় চাইলে যে কাউকে ধরা যায়।

এই আইনে এ যাবত যতগুলো মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বক্তব্য, মতামত অথবা সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশের জেরে কোনো না কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির মানহানির অভিযোগে। অথচ মানহানির প্রতিকার পাওয়ার জন্য দেশের প্রচলিত দ-বিধিতেই (৪৯৯ ধারা) বিধান রয়েছে। তাহলে কারও মানহানি হলে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন কেন? এই আইনটি বেশি শক্তিশালী এবং অধিকতর ভীতিসঞ্চারকারী বলে? দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি মামলা করলে পুলিশ তৎক্ষণাত কাউকে গ্রেফতার করে না বা আদালত সহজে জামিন দিয়ে দেন বলে?

যার মানহানি হয়, যদি তিনি জীবিত হন তাহলে মামলা করার কথা তার নিজের। কোনো মৃত ব্যক্তির মানহানি হলে তার পক্ষে অন্য কেউ মামলা করতে পারেন। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবত যতগুলো মামলা হয়েছে, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তার বাদী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিজে নন; বরং তার পক্ষে অন্য কেউ মামলা করেছেন। অর্থাৎ এখানে শুধু মামলা করাই নয়; বরং ক্ষমতা দেখানোরও একটা বিষয় কাজ করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবত যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই দুর্বল; কিন্তু এসব দুর্বল অভিযোগে পুলিশ কেন মামলা নিল, সে প্রশ্নও আছে।

গত ২৬ জুন একটি প্রথম সারির পত্রিকার খবরে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এখন প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের বরাতে ওই খবরে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই মামলার সংখ্যা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কটূক্তিমূলক’ পোস্ট দেওয়া, পোস্ট শেয়ার করা, কার্টুন বা ব্যাঙ্গাত্মক চিত্র আঁকা, ই-মেইলে যোগাযোগ করা এবং নিজেদের মধ্যে চ্যাট করার দায়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ এ বছর গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৮ জন সাংবাদিক।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর মামলার আসামিদের একটি বড় অংশ ত্রাণ চুরি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন বা কার্টুন এঁকেছেন। তাদের অনেককেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে তুলে নিয়ে যায়। পরে ডিজিটাল মামলায় তাদের আদালতে পাঠানো হয়। যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গত ৯ মার্চ মামলা করেছিলেন মাগুরা-১ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর।

ওই মামলায় আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এখনো কারাগারে। সর্বশেষ, গত ২৩ জুন তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম। গত মার্চের প্রথম দিকে এই মামলা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস নিখোঁজ ছিলেন কাজল। গত ২ মে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করে বিজিবি।

প্রসঙ্গত, কোনো পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত সংবাদের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদলিপি পাঠানো যায়। সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম তাদের ব্যাখ্যাসহ প্রতিবাদ প্রকাশ করবে। তাতে সুরাহা না হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন। তাতেও বিষয়টির নিষ্পত্তি না হলে আদালতে যাওয়ার পথও খোলা রয়েছে; কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসার পর প্রচলিত এসব বিধান এখন অকার্যকর। যদিও সরকার প্রেস কাউন্সিলকে এখনো বিলুপ্ত ঘোষণা করেনি। আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যাতে সাংবাদিকদের বা সাংবাদিকতা সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তিতে ব্যবহার করা না হয়, সেজন্য প্রেস কাউন্সিল যে সরকারের ওপরে চাপ প্রয়োগ করেছে, এমন সংবাদও শোনা যায়নি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫