Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সাহেদের কী হবে?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২০, ০১:৩০

সাহেদের কী হবে?

রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদের গ্রেফতার ইস্যুতে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে, এই লোকটির গ্রেফতার বা শাস্তির মধ্য দিয়ে দেশ বোধ হয় দুর্নীতিমুক্ত হলো। আসলে কি তা-ই? 

৬ জুলাই করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের পর ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে টাকা আদায়ের অভিযোগে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। পরের দিন উত্তরা পশ্চিম থানায় সাহেদকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ৯ দিন পর সাতক্ষীরা থেকে সাহেদকে গ্রেফতারের কথা জানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, সাহেদ অন্তত ১৮ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার প্রতারণার ধরন দেখে র‌্যাব বলছে, প্রতারণার জগতে সাহেদ ‘আইডল’। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই তিনি বিভিন্ন অপকর্ম করেছেন। এ বিষয়ে কেউ কিছু বললেই দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন। যদিও কারও সঙ্গে কারও ছবি থাকা মানে এই নয় যে, তিনি তার পৃষ্ঠপোষক।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মানুষ ছবি তুলতে চায়, এটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে যাদের সঙ্গে সাহেদের ছবি আছে, তারা সবাই যে তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বা সবাই যে সাহেদের অপকর্মের কথা জানতেন, তা নিশ্চয়ই নয়। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অনেকের সঙ্গে সৌজন্যবশতও ছবি তোলেন। সাহেদ যাদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন বা যাদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা আছে বলে মনে হচ্ছে, তারা আসলেই তার অপকর্মের পৃষ্ঠপোষক কি না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

প্রসঙ্গত, গত চার-পাঁচ বছর ধরে সাহেদ নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। টকশোতেও তাকে নিয়মিত দেখা যেত। প্রশ্ন উঠেছে, সাহেদকে কি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ স্বপ্রণোদিত হয়ে, অর্থাৎ তিনি ভালো আলোচক বলে তাকে টকশোতে আমন্ত্রণ জানাতো; নাকি সাহেদ নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে টেলিভিশনে যেতেন? 

বাস্তবতা হলো, টকশোতে কে আসবেন না আসবেন, সেটি সব সময় ওই অনুষ্ঠানের প্রযোজক, উপস্থাপক এমনকি হেড অব প্রোগ্রামের ওপরেও নির্ভর করে না। বরং অনেক অতিথিকে নানা মহলের সুপারিশ ও চাপে আনতে হয়। কখনো মালিকপক্ষেরও চাপ ও এজেন্ডা থাকে। সুতরাং কোন প্রেজেন্টারের টকশোতে সাহেদ গেলেন এবং সেখানে ওই প্রেজেন্টারের দায় কতটুকু- সে বিষয়ে চট করে মন্তব্য করা কঠিন।

দ্বিতীয়ত, টিভি টকশোতে কিছু অতিথি আসেন পয়সা দিয়ে। সব সময় সেই পয়সা সরাসরি অনুষ্ঠানের প্রযোজক বা উপস্থাপক নেন না। বরং সেটারও আলাদা মেকানিজম আছে। সুতরাং অনুসন্ধানের বিষয় হলো, সাহেদ যেসব টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়েছেন, সেখানে তিনি কি বিশেষ মহলের সুপারিশ/চাপে গিয়েছেন নাকি পয়সা দিয়ে গিয়েছেন, নাকি প্রযোজক-উপস্থাপক বা টিভি সংশ্লিষ্ট অন্য কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে গিয়েছেন? সাহেদ যে ধরনের প্রতারক বলে এরই মধ্যে মিডিয়ায় খবর এসেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফেও জানানো হয়েছে, তাতে তিনি যে পয়সা দিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এমনকি বিভিন্ন মহল থেকে চাপ প্রয়োগ করে টিভির টকশোতে যেতেন, সেটির সম্ভাবনাই বেশি। 

সাহেদের সঙ্গে অন্যান্য প্রতারকদের মূল তফাৎটা এই জায়গায় যে, সাহেদ নিজের প্রতারণার জন্য একইসঙ্গে অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তোলা ছবি ও সেলফিকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেইসঙ্গে করোনাকালে নিজের হাসপাতালে মানুষের চিকিৎসা দিয়ে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলারও চেষ্টা করেন। করোনাভাইরাসের রিপোর্ট জালিয়াতির বিষয়টি ধরা না পড়লে তার অন্যান্য প্রতারণার বিষয়গুলো হয়তো কোনোদিনই জানা যেত না। তা ছাড়া যেহেতু মিডিয়ার একটি বড় অংশ এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল, ফলে কেউ সাহেদের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সাহস পেত না। 

এখন অনুসন্ধানের বিষয়, সাহেদের যেহেতু প্রতারণার অতীত অভিজ্ঞতা আছে এবং তিনি এজন্য জেল খেটেছেন, অসংখ্য মামলাও হয়েছে, ফলে এ রকম একজন লোক কীভাবে, কত টাকা দিয়ে বা কোন ক্ষমতার বলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য হতে পারলেন। কারা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে এবং কিসের বিনিময়ে? সাহেদকে যারা নিয়মিত টেলিভিশনের টকশোতে নিয়ে আসতেন, তারা কোন স্বার্থে, বা কোন বিশেষ মহলের চাপে এমনটা করতেন? 

সাহেদের স্ত্রী মিডিয়ায় বলেছেন, তিনিও প্রতারক স্বামীর বিচার চান। প্রশ্ন হলো, তার স্বামী যে বছরের পর বছর ধরে মানুষের সঙ্গে নানা ধরনের প্রতারণা করে আসছিলেন, তিনি কি তা ঘূণাক্ষরেও টের পেলেন না? গ্রেফতার হওয়ার পরে বলছেন তিনিও বিচার চান, অথচ তার স্বামী আগেও গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন, অসংখ্য মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে, সেসব খবর তো স্ত্রী হিসেবে তার অজানা থাকার কথা নয়। আগে তো কখনো বলেননি যে, তিনি স্বামীর বিচার চান। এখন কেন বলছেন? কারণ অতীতে সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বা তিনি কারাগারে গেলেও তাকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রল হয়নি। মিডিয়ায় তাকে নিয়ে সেভাবে রিপোর্ট হয়নি। এবার হচ্ছে মূলত করোনাভাইরাসের রিপোর্ট জালিয়াতির কারণে। এই ইস্যু না থাকলে এবারও তাকে নিয়ে সামাজিকমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমে খুব একটা তোলপাড় হতো কি না সন্দেহ। তখন হয়তো আর দশজন প্রতারকের মতোই সাহেদ ট্রিটমেন্ট পেতেন; কিন্তু অন্যান্য প্রতারণার সঙ্গে করোনাভাইরাসের ইস্যুটি যুক্ত হওয়ায় এটি নিয়ে সবাই নড়েচড়ে বসেন।

সাহেদ যেহেতু টেলিভিশনের টকশোর নিয়মিত আলোচক হিসেবে নানা বিষয়ে জাতিকে জ্ঞান দিতেন এবং নিজেকে সরকারের লোক হিসেবে পরিচয় দিতেন; উপরন্তু দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত মানুষদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো ফেসবুকে আপ করতেন; ফলে মানুষ যখন তার প্রতারণার খবর জানল, তখন এই প্রতারণার সঙ্গে সঙ্গে তাকে টিভিতে কারা নিয়ে এলেন, কীভাবে তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য হলেন, কীভাবে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত লোকদের সঙ্গে তিনি ছবি তুললেন, কীভাবে তাদের ঘনিষ্ঠ হলেন- সেসব নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়। 

এটি হচ্ছে প্রতারণার ‘সাহেদ স্টাইল’। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেটি সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া এবং নিজের অফিস ও বাসায় সেসব ছবি টানিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে সাহেদ নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রমাণ করতেন এবং তিনি চাইতেন লোকজন তাকে সমীহ করুক। তার সঙ্গে নিয়মিত টেলিভিশনের টকশোতে গিয়ে সরকারের পক্ষে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমালোচনার মাধ্যমে তিনি সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করতেন। যেহেতু একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল, ফলে নিজেকে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রমাণের কাজটি তার জন্য সহজ হয়। 

গ্রেফতারের পর সাহেদকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সব প্রমাণিত হলে তার বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হওয়ার কথা; কিন্তু সেটি বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, গ্রেফতার করে তাকে হেলিকপ্টারে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার পর তিনি র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এমনকি তিনি র‌্যাবের মহাপরিচালককেও নাকি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে, ছয় মাস পরে তিনি তার (র‌্যাব ডিজি) সঙ্গে চা খাবেন। গ্রেফতার হওয়ার পরও সাহেদ এ রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ যে করতে পারছেন, তার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারেÑ ১. তিনি বিশ্বাস করেন যে, তার সঙ্গে ক্ষমতাবানদের যে ধরনের সম্পর্ক এবং তিনি যেভাবে ক্ষমতাবানদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, তাতে শেষ পর্যন্ত হয়তো তারাই তাকে বাঁচাবেন বা তার পাশে দাঁড়াবেন। ২. কেউই আর সাহেদের অপকর্মের দায় নেবেন না; কিন্তু সাহেদ এখনো এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছেন। 

তবে শেষমেশ আসলেই সাহেদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা এখনই বলা মুশকিল। অতীতে দেখা গেছে, অনেক বড় অপরাধীও গ্রেফতারের পরে অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে পুলিশি পাহারায় জীবনযাপন করেন। সাহেদও অপরাধের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন এবং সরকারের ভেতরে তার যে প্রভাব, এমনকি মিডিয়ার একটি অংশও যেহেতু তার কাছ থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত- ফলে বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত সাহেদকে কতদিন জেলে থাকতে হবে; তিনি কি কারাগারেই থাকবেন নাকি হাসপাতালে; কতদিনে তার বিচার শেষ হবে; তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কতগুলো প্রমাণ করা যাবে- সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে। তবে মুশকিল হলো- খুব শিগগিরই মানুষ সাহেদের কথা ভুলে যাবে। আরও এক বা একাধিক ইস্যু সামনে চলে আসবে, যা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হবে। ধীরে ধীরে সাহেদ ইস্যুটা দৃশ্যের বাইরে চলে যাবে। যেমন চলে গেছেন সম্রাট ও জিকে শামীম। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫