Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সলিমুল্লাহ খান: এক নিঃসঙ্গ শেরপা

Icon

এ কে এম মাজহারুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২০, ১৭:০৬

সলিমুল্লাহ খান: এক নিঃসঙ্গ শেরপা

সলিমুল্লাহ খানের গুণ গেয়ে শেষ করতে পারব না। তাই সেই দিকে যাচ্ছি না। আমি আজ বরং একজন দূরবর্তী পাঠক এবং একজন আগুন্তুক অনুচর হিসেবে সলিমুল্লাহ খানকে কীভাবে দেখতে পাই, তাই নিয়ে আপনাদের সঙ্গে যৎসামান্য আলাপ আলোচনা করি। আলাপই বেশি। আলোচনা তেমন নেই।

সলিমুল্লাহ খানের নামের আগে বহু বিশেষণ দেওয়া যায়। অনেকেই তাকে ‘চিন্তক’ বলে থাকেন। মানুষ মাত্রই চিন্তক। আমি, আপনি সবাই চিন্তা করি, সেই অর্থে আমরা সবাই চিন্তক। তাঁকে আলাদা করে ‘চিন্তক’ বলা হয়, কারণ তিনি মুখস্ত চিন্তার বাইরেও মৌলিক চিন্তা করেন। মুখস্ত কথার বাইরেও মৌলিক কথা বলেন। তিনি ভাবেন। তাই তাকে ভাবুকও বলা যায়। 

আমি যতটুকু দেখতে পাই, তার আগ্রহের বিষয় হলো- ইতিহাস, সমাজ এবং মানুষ। আজকাল ব্যক্তি মানুষই তার চিন্তার মূল বিষয়, যাকে ইংরেজিতে সাইকোলজি বলতে পারি। আইন বিষয়ে পড়ালেখা করলেও আমার মতে, আদতে তিনি একজন সাহিত্য-অনুপ্রাণিত সমাজ বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। আজকাল অবশ্য তিনি মনোবিজ্ঞানীও বটে। সাহিত্য বিষয়ে তার আজন্ম আগ্রহ তার চিন্তাকে একটি পরিশিলিত মাত্রা দেয়, কারণ সাহিত্য হলো জীবনের সবচেয়ে শিল্পিত মাধ্যম। তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে; কিন্তু এটা তার খুব আগ্রহের বিষয় বলে মনে হয় না। 

ছাত্রাবস্থায় তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকা প্রকাশনা বিষয়ে এই পরিসরে সামান্য শিবের গীত গাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে ১৮৪০-৪৪ পর্যন্ত এমারসন ও ফুলার সম্পাদিত ‘দ্যি ডায়াল’ই প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে স্বীকৃত। তারপর ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘স্যাভয়’ এবং মনরো ও এজরা পাউন্ড সম্পাদিত ‘দি পোয়েট্রি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশে বঙ্কিম চন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭২) এবং প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪), সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘সাধনা’ এবং পরবর্তীকালে ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯২৪), ‘কালিকলম’ (১৯২৭), ‘প্রগতি’ (১৯২৭), ‘পূর্বাশা’ (১৯৩২) ইত্যাদি পত্রিকা এই অঞ্চলে সাহিত্য প্রবাহকে বেগবান করেছে। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ (১৯৩৫), ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ (১৯৪৯), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’, সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ (১৯৫৭), বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত ‘সংস্কৃতি’ বাঙালী মনীষার চেতনাজগতকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হামিদা হোসেন ও রেহমান সোবহান ‘ফোরাম’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেন, যা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চলে। অমর্ত্য সেন, তারিক আলী, কুলদীপ নায়ার, আহমেদ রশিদের মতো কীর্তিমানেরাও সেখানে প্রবন্ধ লিখেছেন। ষাটের দশকে আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ ‘কন্ঠস্বর’ সম্পাদনা করে ঢাকার বাংলা সাহিত্য জগতে এক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৯৭৯-৮৬ পর্যন্ত সলিমুল্লাহ খান ‘প্রাক্সিস জার্নাল’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন, যা সেই সময়ের বিদ্যাজাগতিক ও চিন্তার জগতে একটি ব্যতিক্রমী ও সাড়া জাগানো উদ্যোগ হিসেবে প্রশংসিত হয়। আমার মতে, সলিমুল্লাহ খানের এই অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান হয়ে উঠার প্রথম বীজ সেখানেই রোপিত হয়। 

ড. সলিমুল্লাহ খান একজন উদ্যমশীল ব্যক্তি। এই গুণ তিনি পেয়েছেন সম্ভবত তার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফা’র কাছ থেকে। তারা উভয়েই গুণীর কদর করতেন। সলিমুল্লাহ খানও অগ্রজ অনুজদের গুণের কদর করেন। চট্টগ্রামের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদয়ালয়ে আইন শাস্ত্রে পড়তে এসে ১৯৭৬ সালে তার আহমদ ছফার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং এটা তার জীবন প্রবাহে এক উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জীবন, লেখা পড়া, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, প্রাক্সিস জার্নাল সম্পাদনা, আহমদ ছফা ও আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তার লেখায়, বক্তৃতায়, আড্ডায়, সাক্ষাৎকারে বহুবার উঠে এসেছে। যুক্তাষ্ট্রের নিউ স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া ও অনুপ্রেরণা সম্পর্কে এবং তার খণ্ডকালীন ইউরোপ বাস সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। কারণ সেই বিষয়ে তিনি খুব কিছু আলোকপাত করেননি। মার্ক্স, প্লেটো, ফ্রাঞ্জ ফানো, জ্যাক লাকা, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, লেভি স্ট্রস, এডওয়ার্ড সাঈদ, তালাল আসাদ, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, শার্ল বোদলেয়ার তার চিন্তা ও মননকে অলংকৃত করেছে।

তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘সেন্টার ফর এশিয়ান আর্টস অ্যান্ড কালচার’ এবং ‘আহমদ সফা রাষ্ট্রসভা’ তাকে সংগঠক হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। 

সলিমুল্লাহ খানের প্রথম বই- ‘জাতীয় অবস্থার চালচিত্র’ (১৯৮৩) অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ‘বাংলাদেশ: স্টেট অব দ্য নেশন’ নামক বক্তৃতার একটা রিভিউ। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে ‘আহমেদ ছফা সঞ্জীবনী’, ‘বেহাত বিপ্লব’, ‘আদম বোমা’, ‘গরীবের রবীন্দ্রনাথ’, ‘প্রার্থনা’ অন্যতম। 

আমি তার সম্পর্কে যতদূর দেখেছি, পড়েছি ও শুনেছি তিনি প্রকৃত অর্থে ইতিহাসের এক নিবিড় পাঠক। চোখের আলোয় তিনি চোখের বাহিরে দেখতে চেয়েছেন। তিনি সদালাপী এবং চিত্তাকর্ষক হৃদয় ও মননের অধিকারী। ফলে তিনি মানুষকে কাছে টানেন এবং পাঠক ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। ছাত্র জীবনে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বক্তৃতার উপর এমন একটা ক্রিটিক রচনা করা তার সৎ সাহস ও বলিষ্ঠতা প্রকাশ করে। ‘প্রার্থনা’ সত্তর ভাগ আত্মজৈবনিক আর ত্রিশভাগ সমসাময়িক সামাজিক বিজ্ঞানীদের পাঠ পর্যালোচনা। বইটিতে তার অন্তঃর্দৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা দৃশ্যমান। তিনি তার বন্ধু রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, তারেক মাসুদ, মোহন রায়হান, অভীক ওসমান, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাকী ছাড়াও গুরু আব্দুর রাজ্জাক, লেখক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কমরেড মুজাফফর আহমদ, আবুল কালাম আজাদ, আবুল বারাকাত, ফিদেল কাস্ত্রো ও এডওয়ার্ড সাঈদ সম্পর্কে লিখেছেন। তার ভাষায় এগুলো ‘ফেস্টশ্রফট’ বা ‘উৎসব লেখামালা’। লেখাগুলো সুখপাঠ্য। 

সলিমুল্লাহ খান জীবনে বহুকিছু করতে চেয়েছেন। বহু বিষয়ে পড়তে চেয়েছেন। বহুবিধ বিষয়ে নিরন্তর নিবিড় পাঠ তার চিত্তে এক বিদ্যাজাতিক বহুমাত্রিকতা বা এনসাইক্লোপেডিক বা পলিমেথিক মাইন্ডের জন্ম দিয়েছে, যা তিনি দিনের পর বিপুল ধারায় বিকশিত করেছেন। এটা তাকে যেমন পন্ডিত হিসবে এক সুখ্যাতি দিয়েছে, তেমনি তাকে একগ্রভাবে কোনো এক বিষয়ের গভীরে প্রোথিত হয়ে তত্ত্ব নির্মাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। নিজেরই নতুন কোনো তত্ত্ব সৃষ্টি করার বিরল ক্ষমতা তার ছিল।

আঁধারগোনাগ্রামে তার নানিজান জরিমন খাতুনের সান্নিধ্যে তার শৈশবের আনন্দের দিনগুলো কেটেছে বলে তিনি পাঠকদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা অনুমান করি ইতিহাসের নিরিড় ছায়াঘন পথে হেঁটে যেতে যেতে এই অনন্ত নক্ষত্র বিথিকার নিচে আটলান্টিকের এপারে-ওপারে আরও কিছু আনন্দ সময় তার নিশ্চয়ই কেটেছে। প্রত্যাশা ও প্রার্থনা এই যে সূর্যের নিচে ইহধামের বাকি সময়টুকু তিনি আনন্দে আর উদ্যমে বেঁচে থাকবেন। প্রাচ্যদেশজাত বঙ্গীয় সন্তান হিসেবে থেকে প্রতিচ্য ও পাশ্চাত্যকে কিছু তত্ত্ব উপহার দেবেন।


লেখক

অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫