
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহারের বিধান মানুষকে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ঠিক রাখতে দিচ্ছে না। নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরে আপন ব্যক্তিত্ব আড়াল করতে হচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশে কিছু মানুষের জন্য মাস্ক ব্যবহার শাপে বর হয়েছে। কষ্ট করে অতিরিক্ত কোনো কাপড় ব্যবহার করে নিজেদের আড়াল করতে হচ্ছে না। মাস্ক ব্যবহার করে নিজের নাম-পরিচয় ঢেকে রাখতে পারছে।
শক্তিমানদের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি আলাদা। তাদের নিজেকে আড়াল করতে হয় না। তারা আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থেকে নিজের শক্তি ও সামর্থ্য প্রকাশ করেন। কারণ কয়েক প্রজন্মের আভিজাত্যপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজ শক্তি ও সামর্থ্যকে আড়াল করলেও কাক্সিক্ষত পরিচয় আড়াল করা সম্ভব নয়, যা কিছু করতে হয় প্রকাশ্যেই করতে হয়। কোনো কিছু আড়াল করার প্রয়োজন পড়ে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এদের দু’কান কাটা হয়ে গেছে। বুকের ওপর বসে নিজেদের কাজ করে। ভাগ-যোগে সমস্যা না হলে কেউ দেখতে পায় না। আর এসব সুন্দরের মধ্যে অসুন্দর হঠাৎ করে সামনে আসতেই দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের দায়বদ্ধতা, যোগ্যতা ও একনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে, বলীয়ান হয়ে পড়ে মাটি ও মানুষের প্রতি প্রেম প্রমাণে। দ্বিতীয় ইস্যুটি না আসা পর্যন্ত প্রথমটা নিয়ে শতব্যস্ত থাকেন তারা; কিন্তু শেষ বিচারে কি হলো, তা সাধারণের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। এক সময় নতুনকে বরণ করতে গিয়ে পুরনো বিদায় নিয়ে নেয়। নিয়ত চলমান এ প্রক্রিয়ার মধ্যে কেউ কোনো কারণে চিহ্নিত হয়ে পড়লে, তখন সাধারণের সামনে নিজেকে আড়াল করার প্রবণতা দেখা যায়। করোনা সতর্কতায় মাস্ক ব্যবহারের বিধান- এ সমস্যা থেকে আপাতত এসব মানুষকে মুক্তি দিয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘চোরের খনি’ পেয়েছিলেন আর বর্তমান সরকার বিগত বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে রোপিত ‘দুর্নীতির বিষবৃক্ষ’ পেয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রাপ্ত চোরের খনিকে ফুলে-ফলে পল্লবিত করা ও দুর্নীতির বিষবৃক্ষকে মহীরুহে পরিণত করা আজ তাই জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে পালন করছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে শাসক শ্রেণি গভীর আন্তরিকতায় আর সাফল্যের সাথে তা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশ কোন কোন বিষয়ের রোল মডেল, তা সংশ্লিষ্টরা না বলে দিলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তবে চোরের খনি ও দুর্নীতির বিষবৃক্ষ লালনে শাসকশ্রেণি যে দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখেছে, তা বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল করতেই পারে। বিষবৃক্ষ লালনের এ প্রক্রিয়া সরবে, সদর্পে চলমান রয়েছে। মাঝে মধ্যে শুধু সতর্কতার সাথে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হুংকার শোনা যায় জিরো টলারেন্সের এবং কাউকেই ছাড় না দেওয়ার। সে অঙ্গীকার রক্ষায় বলির পাঁঠাদের প্রকাশ্যে টানাটানি চলে আর সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা বিবেচনায় হাত-পা ঝেড়ে নতুন আরেকটা বলির উপকরণের সন্ধানে নিবেদিত হয়ে পড়ে। কোনো মুখোশের প্রয়োজন তো হয় না বরং অনুকরণীয় নির্লিপ্ততা ও নিষ্ক্রিয়তা বিরাজ করে। বিপরীতে জনকল্যাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকরা মুখোশের আড়ালে থেকে কর্তব্য পালন করে চলে।
সাধারণ মানুষ দেখছে ব্যাংকের ভল্টে ২২ ক্যারেট সোনা রাখলে তা ১৮ ক্যারেট হয়ে যায়, কয়লা খনি থেকে দেড় লাখ টন কয়লা গায়েব হয়ে যায়, প্রকল্পের ৩০ কোটি টাকার ৭০টি গাড়ির হদিস পাওয়া যায় না, প্রকল্পের মহাপরিচালক অবলীলায় ৫৪১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলে, ব্যাংকের এমডি সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যায়, সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি করে জামিন পেলেও টাকা উদ্ধার হয় না, শেয়ার ধসের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে পথে বসানো হয়, ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। সাধারণ মানুষ দেখছে ৫ হাজার ৫৫০ টাকা দামের তালা, ৮৫ হাজার টাকা দামের বই, ৩৭ হাজার টাকা দামের পর্দা, ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দামের হেড কার্ডিয়াক স্টেথিস্কোপ, ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা দামের ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন, ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা দামের অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট, ৬ লাখ টাকা দামের কলা গাছ, ৬২ লাখ টাকা দামের নারিকেল গাছ, ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দামের কাঠের চেয়ার, আদম শুমারির ১ পাতা প্রশ্ন ছাপতে ব্যয় ৮ টাকা ৩৭ পয়সা, ২ কোটি টাকার টিনের বাড়ি। সাধারণ মানুষ দেখছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর গরিব মানুষকে হাত ধোয়া শেখাবে, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর বিল্ডিং দেখতে বিদেশ যাবে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে যাবে, পয়ঃনিষ্কাশন দেখতে আফ্রিকায় যাবে, পুকুর কাটা, টিচিং কোয়ালিটি উন্নয়নে কর্মকর্তারা বিদেশ যাবে।
সাধারণ মানুষ এসবের পাশাপাশি ক্যাসিনো সম্রাট, সিন্ডিকেট ব্যবসার দাপট দেখেছে। দেখেছে বিদ্যুতের ভালো ডিজিটাল মিটারগুলো বাতিল করে নতুন প্রিপেইড মিটার বসানোর প্রকল্প। দেখছে দায়িত্বপ্রাপ্তরা মুখোশ পরে থাকার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সাহেদ, সাবরিনা, মিঠু, পাপিয়া, সম্রাট, নূর জাহান, মিজান, মালেক, হালদার, সাবেরুলসহ শত সহস্র মানুষ।
সাধারণ মানুষের ধারণা প্রকাশ্যে আসা ব্যক্তি ও ঘটনার চাইতে অনেক কিছু অপ্রকাশ্যে রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা মুখোশ পড়ে থাকার কারণে নিজ স্বার্থে অনেক কিছু প্রকাশ করতে চায় না। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একান্ত বাধ্য হয়ে যে সব প্রকাশ পায়, তার দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ পর্যন্ত কেউই দায় নেয়নি। কোনো ঘটনা একদিনে ঘটে না। কেউ যদি মনে করে সকালে অফিসে গিয়ে অধিদফতরের ৫৪১ কোটি টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরবে বা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যাবে, তা কি সম্ভব? দিনের পর দিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ অর্থ আত্মসাৎ হচ্ছে। প্রকল্প তৈরি, অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তারপর তার বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্টরা বিদেশে গিয়েছে। মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন, অনুমোদন, কার্যদেশ প্রদান করার পর, তারপর সরবরাহ হয়েছে। এই বিশাল প্রক্রিয়ায় যারা সংশ্লিষ্ট তাদের অংশগ্রহণের ফল ১৫০ টাকার তালা ৫ হাজার ৫০০ টাকা দামের হয়ে যাওয়া। অথচ দায় গ্রহণ তো পরের কথা সংশ্লিষ্টদের অনেকক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের পুরস্কার প্রাপ্তিযোগ ঘটতে দেখা যায়। বন্দুকের নল অন্যের কাঁধে রেখে দেশে সবাই শিকার করে চলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হয়েও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বয়ং হাজির থেকেও সংশ্লিষ্টরা তা অস্বীকার করে সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রতি কি প্রচণ্ড বিশ্বাস?
দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্তব্য পালনে প্রধান বাঁধা জনবল সংকট। এমন একটা সেক্টরের হদিস কেউ দিতে পারবে না, যেখানে জনবলের সংকট নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স, প্রশাসনে কর্মচারী, কারিগরি ক্ষেত্রে প্রকৌশলী, শিল্প-কারখানায় শ্রমিক, অধিদফতরে কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে লোকবল নেই। সর্বত্র জনবল সংকট। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকরা দিনরাত এক করে শ্রম দিয়ে চলেছে, যাতে ঘটনা ঘটার পর হাজির হওয়া ভিন্ন কোনো উপায় তাদের কাছে না থাকে। আর জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তারা কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে কর্তব্য সারেন। এমতাবস্থায় করোনাভাইরাস মানুষের জীবন রক্ষায় মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে।
সাধারণ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা আরো বিপুল বিক্রমে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারবেন। এতে দেশ ও জনগণের কল্যাণে টেন্ডার বাণিজ্য রমরমা হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ, বিদেশে অর্থ পাচার ও সেকেন্ড হোম বাড়বে, সিন্ডিকেট ব্যবসা রমরমা হবে, প্রতিটা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জোয়ার বইবে। জয়তু মাস্ক।
লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ