
রাজধানীর ধোলাইখাল এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে হেফাজতে ইসলাম নামক একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধিতার ইস্যুতে বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সংবাদমাধ্যমেরও নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম এটি।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। বিশেষজ্ঞদেরও অনেকে এই মত দিচ্ছেন। তাতে করে এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে বা যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুতর আকারে দেখা দিয়েছে তা হলো- ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। এই কথা বলে ভাস্কর্য আর মূর্তিকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে কি-না এবং যারা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মূর্তি পূজা করেন, তাদের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি-না?
দেশে বহু বছর ধরেই বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু প্রখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য রয়েছে। রাজধানীর বুকেই অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। সুতরাং হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি হলো কেন ও এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি-না?
আরো প্রশ্ন- যেহেতু দেশের সংবিধান বা কোনো আইন অনুযায়ী ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ অবৈধ নয়; সুতরাং বঙ্গবন্ধু কিংবা অন্য যে কারও ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা অসাংবিধানিক ও বেআইনি কাজ হওয়া সত্ত্বেও সরকার কেন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না?
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি হলে একটি পক্ষ এটি প্রমাণে খুব সোচ্চার যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়। নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খানও এই কথা বলেছেন। এ কথা ঠিক যে, মূর্তি নির্মাণের উদ্দেশ্য ধর্মীয়; কিন্তু ভাস্কর্যের উদ্দেশ্য শিল্প। আবার এখন মূর্তি নির্মাণের সাথে শিল্পও যুক্ত হয়েছে। কারণ কোন মন্দিরের প্রতিমা কত সুন্দর, কত বড়- সেটিও প্রতি বছর দুর্গা পূজার সময় আলোচনায় থাকে। এর সাথে সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিরও বিষয় থাকে। এখানে উৎসবেরও ব্যাপার থাকে।
পক্ষান্তরে, বিখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকে না; কিন্তু মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। উদ্দেশ্য ও অনুপ্রেরণায় তফাৎ আছে।
যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেই সেটি ইসলামী রাষ্ট্র হয় না, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয় এবং এখানে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে এবং রাষ্ট্র সব ধর্মের মানুষের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে দায়বদ্ধ। সুতরাং এখানে মূর্তি পূজাও অবৈধ বা বেআইনি নয়। যারা মূর্তি পূজা করছেন, এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার।
যারা মূর্তি পূজা করেন, এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। অতএব, যখন বলা হয় মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়, তখন মনে হয় যে, মূর্তি ভাঙলে যেন ক্ষতি নেই। এই ধরনের আলোচনা বিপজ্জনক ও কোনো রাষ্ট্রে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি বাধা সৃষ্টি করে। সুতরাং কেন ও কী উদ্দেশ্যে এটি বলা হচ্ছে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়? অবশ্যই এক নয়; কিন্তু এটি ঘটা করে বলার মধ্য দিয়ে আমরা কি মূর্তি ও ভাস্কর্যকে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছি না। এর মধ্য দিয়ে আমরা কি এটি প্রমাণ করছি না যে, ভাস্কর্য ভালো আর মূর্তি খারাপ?
রাষ্ট্র যখন সব ধর্মের মানুষের অধিকার স্বীকার করে ও সবাই যার যার ধর্ম পালন করতে পারবে বলে সাংবিধানিকভাবে ঘোষণা দেয়, তখন ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়’ বলার মধ্য দিয়ে যারা মূর্তি পূজা করেন তাদের ‘মাইনর’ করে ফেলা হয়। বরং রাষ্ট্রকে এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারার মেরুদণ্ড থাকতে হয় যে, দেশে মসজিদ থাকবে, মন্দির থাকবে, মন্দিরে মূর্তি থাকবে এবং রাষ্ট্র তার সুরক্ষাও দেবে। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই কট্টর ইসলামপন্থীদের সাথে ক্ষমতাসীনদের যে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে উঠেছে- তার কারণেই এখন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনেরও বিরোধিতার সাহস পায় এবং সরকারকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হয় যে, ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়’।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ ও তার পাল্টা হেফাজতে ইসলামের বিশাল সমাবেশকে ঘিরে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনীতি থেকে ‘মাইনর’ হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তথা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত ছিল, আওয়ামী লীগের জন্য হেফাজতে ইসলাম বা এ রকম কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর চেয়ে বিএনপি অধিকতর নিরাপদ। কিন্তু বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ এমন সব গোষ্ঠীর সাথে সখ্য গড়ে তুলেছে যারা আদর্শিকভাবে পুরোপুরি আওয়ামী লীগের বিরোধী। মূলত এই রাজনৈতিক কারণেই এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলার সাহস পাচ্ছে। আবার মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয় বলে ‘ফতোয়া’ দিয়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এই রাজনৈতিক সখ্যের কারণেই বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করার মামলায় এ পর্যন্ত বহু লোককে গ্রেফতার করা হলেও ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করতে গিয়ে যে উগ্রবাদী গোষ্ঠী প্রকারান্তরে সরকারকেই হুমকি দিচ্ছে, তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা এবং ‘ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা ছুড়ে ফেলা হবে’- এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য বা হুঁশিয়ারির পরও কেউ গ্রেফতার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তার মানে, একই ধরনের অপরাধ করলেও সবার প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ অভিন্ন নয়?
যেহেতু হেফাজতে ইসলাম একটি বড় ধর্মীয় শক্তি ও আনুষ্ঠানিকভাবে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও তাদের পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক শক্তি আছে, কিংবা বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের সমঝে চলে, সেজন্য তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলার হুমকি দিলেও রাষ্ট্র-সরকার সেখানে নির্লিপ্ত থাকে!