Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রক্তঝরা ডিসেম্বর

Icon

ড. আফসার আহমদ

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২২

রক্তঝরা ডিসেম্বর

বাঙালির কাছে ডিসেম্বর কেবল একটি মাসের নাম নয়, একটির জাতির বীরত্ব ও বিজয়ের ঐতিহাসিক দালিলিক অভ্যুদয়ের নাম। সেই সময়ের মানুষ, যারা এখনো বেঁচে আছেন, অবরুদ্ধ ৯ মাসের মৃত্যুভয়ের দুঃসময়ের দিনগুলোকে মনে করে আবেগে আপ্লুত হন। কারণ ডিসেম্বর তাদের যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছিল। 

বাঙালির প্রতিটি রক্ত কণিকা একযোগে উচ্চারণ করেছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ডিসেম্বরের ষোলো তারিখে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী রেসকোর্সের মাঠে। ডিসেম্বর তাই বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণের নাম। যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা লেখা হয়েছে রক্তের আখরে। 

১৯৭১-এর ডিসেম্বর আর ২০২০-এর ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কাছে এখনো রোদ ঝলমলে মধ্যাহ্নের সূর্যসম। তাদের চোখে ভাসে পাকিস্তানি কামানের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার ছবি। কামানের বিপরীতে থ্রিনট থ্রি রাইফেলের কামান হয়ে ওঠার দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ভাসে। কারণ সেই বন্দুক ছিল একটি জাতির স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। জাতির আশা-আকাক্ষার প্রবল গর্জন ধ্বনিত হয়েছিল সেদিনের মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলে। এখনো সেই আওয়াজ উদ্দীপ্ত করে বাঙালিকে। 

আর এজন্যই ডিসেম্বর এলে ভয় পায় পাকিস্তানিদের এদেশীয় দালালরা। রাজাকার আল-বদরের আত্মা-প্রেতাত্মার ছায়া ও শরীর কম্পিত হয়ে ওঠে এই ডিসেম্বরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যেমন করেছিল একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত সেই শক্তি এই সময়ে এসে বুঝে গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণাকে আঘাত করতে পারলে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থলে আক্রমণ করা গেলে, বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উৎসে বিষ ঢেলে দিতে পারলে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা ফিরিয়ে আনা যাবে বাংলাদেশে। এজন্য তারা আক্রমণ করেছে হায়েনার মতো জাতির পিতার ভাস্কর্যের ওপরে। তারা ধর্মীয় লেবাসে এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ধর্মপ্রিয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। 

এই ডিসেম্বর থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে একাত্তরের ডিসেম্বরে ফিরে গেলে আমরা পৌঁছে যেতে পারব অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির যুদ্ধক্ষেত্রে। সে সময়ে পুরো বাংলাদেশটাই ছিল রক্তাক্ত রণাঙ্গন। বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, কালের প্রহর পেরিয়ে এসে দেখি চেতনার এই দীর্ঘ পথচলায় খুব বেশি এগোনো যায়নি। আজ সেই রাজাকারের উত্তরসূরিরা থাবা বসিয়েছে আমাদের জাতির পিতার ভাস্কর্যে, আমাদের পাঠ্যে, আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্প্রীতির মর্মমূলে। 

নাগিনীরা যখন বিষনিঃশ্বাসে বাংলাদেশের নির্মল আকাশটাকে বিষাক্ত করছে তখন আর ক্ষমা কিংবা করুণা কিংবা আপোষের নয়া মেরুকরণের ফর্মুলায় সমাধান আসবে না। সমাধান কঠোর ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যখন নানা মেরুতে বিভাজিত হয়ে দ্বিধা আর সংশয়ে ঘুরপাক খায়, তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালি স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলে দেশে। এই ডিসেম্বর হয়ে যায় একাত্তরের ডিসেম্বরের ঐতিহ্যধৃত চেতনার উত্তরাধিকার। আমাদের আবেগ ও বিস্ময়যুগপৎ উদ্বেলিত এই ডিসেম্বরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে মূল সংগ্রামের সৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে যারা, তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণ করেনি। এই প্রজন্মের দীপ্তপ্রাণ তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ চাক্ষুস করেনি ঠিক; কিন্তু তাদের ধমনিতে প্রবাহমান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রক্তকণা। ডিসেম্বরে এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কৃতজ্ঞতায় নত হয় একাত্তরের মৃত্যুঞ্জয়ী যোদ্ধারা। আমরা প্রত্যয়ী হয়ে উঠি এই ভেবে যে মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণাকে নস্যাৎ করা সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা ভুলে যেতে পারি স্বাধীনতা বিরোধীদের; কিন্তু তারা ভোলেনি। এই দেশটাকে তারা এখনো নিজের মাতৃভূমি ভাবতে পারেনি। পাকিস্তানের পতাকার দিকে তাদের মুখ ফেরানো। তাদের চেতনায় এখনো উদ্দীপনা জাগায় চাঁদতারা মার্কা পতাকা। আমাদের পতাকার রক্ত লাল সূর্যটাকে তারা সেই পতাকা দিয়ে আড়াল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আর এ জন্যই তারা কৌশলে প্রবেশ করতে চেয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়, পাঠ্যপুস্তকে। বছরের পর বছর ধরে নিঃশব্দে ও সশব্দে তারা একের পর এক আঘাত হেনেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। ধর্ম ও জাতীয় সংস্কৃতিকে তারা স্বতন্ত্র করে দিতে চেয়েছে। বাঙালির ধান-দুর্বা, বিবাহের মঙ্গলাচরণ, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের অঙ্গে-উপাঙ্গে কুঠারের ঘা বসিয়ে দিয়ে তারা আলাদা করতে চাইছে। অথচ তারা জানে মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয় সংস্কৃতি আর ধর্মের কোনো বিরোধ তৈরি করেনি সেখানকার ধর্মীয় নেতারা কিংবা সরকার। বিশ্বের একটি বৃহৎ মুসলিম দেশ হলেও ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় বিমান সংস্থার নাম গরুড় ইন্দোনেশিয়া। হিন্দু পুরাণের পাখি দেবতা গরুড় বলে সেদেশের মুসলমান নেতারা বিমানের ডানা ভাঙেনি। তারা তাদের সংস্কৃতি আর ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেনি; কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মের নামে আফগানিস্তানের তালেবানি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা চায় একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতিক। আর তাইতো এদেশে তারা স্লোগান দিতে সাহস পেয়েছে ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ 

অন্ধত্বের যুগে ফিরে যাওয়ার এই তীব্র ইচ্ছা তাদের দাঁড় করিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। অর্ধ শতাব্দীর ব্যবধানে এখনো তাদের আস্ফালন যায়নি। তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। যে সময়ে দেশটিকে আধুনিক করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন, যে দেশটিকে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছেন, ঠিক সেই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ভিত্তিভূমে আঘাত হেনেছে। তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য বাঙালি মুসলমানের আবেগকে ভুল পথে উসকে দিতে চাইছে। পাকিস্তানি শাসকরা এই কাজটি পারেনি। 

মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৪৭ থেকেই এদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শোষণ করার প্রবণতা পাকিস্তানি শাসকদের। তাই তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছিল; কিন্তু পারেনি। বাঙালি ছাত্র-জনতা রচনা করেছিল বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে শক্তি সঞ্চয় করেছিল বাঙালি জাতি, তা শানিত হয়ে রচিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজকে, এই ডিসেম্বরে এসে বাংলা ভাষাকে প্রথম সারিতে আর দেখা যায় না। অথচ বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। 

ডিসেম্বর তাই ইংরেজি বছরের বিচ্ছিন্ন কোনো মাস নয়, ডিসেম্বর স্বাধীনতাস্পৃহ বাঙালির অদম্য আবেগের নাম। এই মাসেই রচিত হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণের মহান দৃশ্যকাব্য। এই কাব্যের প্রতিটি শব্দ রক্ত দিয়ে লেখা। সমগ্র জাতিকে নিয়ে স্বাধীনতা নামের অমর কবিতাটি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ডিসেম্বরে তার ভাস্কর্য যারা ভেঙেছে তারা একক কোনো ব্যক্তি নয়, বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার রূপকারও নয়, তারা বাঙালির স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত সংঘবদ্ধ অপশক্তি। তাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে নেই। রাষ্ট্রের এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫