Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

‘গণহত্যা’ স্বীকৃতিটিই অর্জন করা গেল না কেন?

Icon

হেলাল মহিউদ্দীন

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২৯

‘গণহত্যা’ স্বীকৃতিটিই অর্জন করা গেল না কেন?

হেলাল মহিউদ্দীন

আর্চার কেন্ট ব্লাডকে আমরা বিশেষ সম্মান দেইনি। তার বিখ্যাত টেলিগ্রামটি শুধুই মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য একটি দলিল নয়, বরং কূটনীতিকের মেরুদণ্ড যে কতটা দৃঢ় হতে হয় তার অনন্য শিক্ষা। 

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল, ২৫ মার্চের গণহত্যার মাত্র দশদিন পরের ঘটনা। আর্চার ব্লাড তখন বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত। নিক্সন-কিসিঞ্জার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের ফাঁক-ফোঁকরে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে চিড় ধরানোর দুষ্টবুদ্ধিতে ব্যস্ত। মার্কিন সমর্থন পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তান আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠলো; কিন্তু ২৫ মার্চের কালোরাতে নির্বিচারে বাঙালি নিধনযজ্ঞ আর্চার ব্লাডের বিবেককে নাড়া দেয়। 

ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইউসিস ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন ওয়াশিংটনকে ঢাকার প্রকৃত অবস্থা জানাবেন। মাত্র দশ দিনেই দুইটি সংস্থার কুড়িজন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে একমত করাতে পারা চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। এত বড় একটি সিদ্ধান্তই বা কীভাবে নিতে পেরেছেন সে এক পরম বিস্ময়! অত্যন্ত শক্ত কথায় ওয়াশিংটনকে জানালেন- ‘আমাদের সরকার যা কিছু দেখাচ্ছে, সেগুলোকে অনেকেই নৈতিক দেউলিয়াত্ব বিবেচনা করবে।’ 

আরো বিস্ময়কর যে, তিনি সেই যৌথ বিবৃতিতে ব্যক্তিগত নোটও দিয়েছেন। ব্যবহার করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে অনেকটাই অকূটনৈতিক শব্দ ‘নৃশংসতা’ (অ্যাট্রসিটিজ), ‘দমনপীড়নমূলক ব্যাবস্থাদি’ (রিপ্রেসিভ ম্যেজার্স) ও আরো অন্যান্য শব্দ। আবার কূটনীতিকসুলভ মার্কিন স্বার্থরক্ষা-ভাবনা জানাতে সেই সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রামে ব্র্যাকেটবন্দী করে জানিয়েও দিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতা দলটি (আওয়ামী লীগ) ‘ঘটনাচক্রে পশ্চিমপন্থী’ (ইনসিডেন্টালি প্রো-ওয়েস্ট), তবু রাশিয়ার নিঃশর্ত সমর্থনও জুটে গেছে। নিজের সরকারকে সরাসরি দায়ী করার সাহস দেখিয়ে লিখেছেন—‘আমাদের সরকার (পশ্চিম পাকিস্তানের) গণতন্ত্র দাবিয়ে রাখাকে ধিক্কার জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে নৃশংসতাকে ধিক্কার জানাতে, এবং নাগরিকদের রক্ষায় শক্তিশালী অবস্থান নিতে।’ 

কেন আর্চার ব্লাড ও কুড়িজন মার্কিন কর্মকর্তা নিজেদের পেশাগত জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে ও টেলিগ্রামটি লিখেছিলেন? কারণ একটিই। তারা গণহত্যাটি চাক্ষুষ করেছেন। ২৬ তারিখের রক্তরঞ্জিত ঢাকা তাদেরকে কূটিনীতির দাস থাকতে দেয়নি। ব্লাডের নাম ও রক্ত উপমার ব্যবহারের টেলিগ্রামটির সঠিক নামকরণ হয়েছিল ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’। ২০১৩ সালে সাংবাদিক ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক গ্যারি ব্রাস লিখলেন সাড়া জাগানো এবং একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্যা ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড অ্যা ফরগটেন জেনোসাইড’।  তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বীভৎস হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত সুনিশ্চিত ‘গণহত্যা’ স্বীকার করে বইয়ের নামকরণ করলেন। সেই সময় হতে বিশ্বময় অনেকেই, যেমন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীমন্তি সরকার, নানা গবেষণা ও প্রবন্ধের শিরোনামেই ‘জেনোসাইড’ ব্যবহার শুরু করেন। 

তার আগেও দুইটি নজরকাড়া বিষয়ের উল্লেখ ছিল। একটি ১৩ জুন ১৯৭১ বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন। তিনি নিজে ও পরিবারকে জীবনাশঙ্কার হুমকিতে ফেলেও প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছিলেন ‘জেনোসাইড’। বিশাল বড় হরফে লেখা সেই প্রতিবেদন বিশ্বের কোনো সচেতন পাঠকেরই দৃষ্টি এড়ায়নি। অন্যটি ১৯৯৭ সালে রওনক জাহানের বই, যার শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’। 

প্রশ্ন ওঠতে পারে তাহলে তার আগে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশিদের গণহত্যাকে, বিশেষত ২৫ মার্চের কালোরাত্রির হত্যাকাণ্ডকে কি আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করা হয়নি? দুঃখজনক হলেও সত্য আন্তর্জাতিক জেনোসাইড ডিরেক্টরিতে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডকে এখনো ‘জেনোসাইড’ স্বীকার করা হয়নি। অসংখ্য বই-পুস্তকে, সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে ও কলামে ‘জেনোসাইড’ শব্দের ব্যবহার আছে বটে। সেরকম ব্যবহার তো স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই জহির রায়হান তার ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রের নামের মাধ্যমেই করেছেন। বাংলাদেশের বাংলাপিডিয়ায়, কিংবা উইকিপিডিয়ায়ও ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ই উল্লেখ করা আছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরও ‘জেনোসাইড’ বলে থাকে। সে কথা হচ্ছে না। আমরা বলতে চাইছি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃতির কথা। যেমন, কানাডার ম্যানিটোবায় পৃথিবীর একমাত্র মানবাধিকার যাদুঘরটি পৃথিবীর অসংখ্য জেনোসাইডকে উপস্থাপন করে। মায়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়নকেও ‘জেনোসাইড’ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় এখনো শুধুই মুক্তিযুদ্ধ। আমি ব্যক্তিগতভাবে যাদুঘরের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকালে সেখানকার গবেষকদের সাথে আলোচনা হয়েছিল। ২৫শ মার্চ-এর নিধনযজ্ঞকে কেন জেনোসাইড বা গণহত্যা উল্লেখ করা হয় না প্রশ্ন করলে তারাও জানালেন যে, বিষয়টি সুরাহা হলে তারাও অবশ্যই ‘জেনোসাইড’ স্বীকৃতি দেবেন।  

অর্থাৎ স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছর পরেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। অর্থাৎ উনপঞ্চাশ বছরেও কোনো সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ‘জেনোসাইড’ স্বীকৃতি পাবার আন্তরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায়নি। এই লেখার স্বল্প পরিসরে তালিকাভুক্ত জেনোসাইডগুলোর উল্লেখ সম্ভব নয়। দশ হাজার হতে পনের হাজার মানুষের হত্যাকাণ্ডও জেনোসাইড তালিকাভুক্ত আছে; কিন্তু তিরিশ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ড হয়েছে, না আরো কম এই সংক্রান্ত দাবিতে আবেগসঞ্জাত তর্কাতর্কি বিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভূমিকম্প তৈরি করে ফেলতে জানলেও আসল কাজের বেলায় আমরা নিতান্তই ব্যর্থ। আমরা সম্ভবত মানতে রাজি নই যে, ইতিহাস আবেগে ভর করে চলে না। 

২০১১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শর্মিলা বসু ‘ডেড রেকনিং : মেমোরিস অব দ্যা নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান ওয়ার’ বইতে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের সংখ্যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত দাবির চাইতে কম বলেছিলেন। তার ফলে তিনি আবেগি উগ্র বাংলাদেশিদের দ্বারা তুলোধুনো হয়েছিলেন। সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কার থাকায় সম্মিলিত আক্রমণের পালে এতই হাওয়া লেগেছিল যে, বিব্রত বসু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ইতিহাসের কাজই তো সত্য অনুসন্ধান করা, প্রশ্ন তোলা, সন্দেহ করা। আবেগ দিয়ে কি ইতিহাসের প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব? ডোনাল্ড বিচলার তার লেখায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বিতর্কের শুরু আসলে আশির দশকের শুরু হতেই। অর্থাৎ শর্মিলা বসুর মতামতেরও অন্তত তিরিশ বছর আগে হতেই পশ্চিমা জেনোসাইড পাঠ বাংলাদেশ প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে চলছিল। বাংলাদেশিদের অতি-আবেগি অবস্থানের কারণে পশ্চিমের ইতিহাসবিদরা এই বিষয়ে নির্মোহ ইতিহাস-পাঠ বা সিদ্ধান্ত দিতেও স্বচ্ছন্দ নন। তাই নির্ভরযোগ্য ও অকাট্য প্রমাণ সরবরাহের দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরই বর্তায় বলে অনেকে মনে করেন। 

ডোনাল্ড বিচলার দেখিয়েছেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে বিতর্কের বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ‘জেনোসাইড’ কী না! জেনোসাইডের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞানুযায়ী বাংলাদেশের গণহত্যা হয়েছে, কি হয়নি তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু উত্তর পাবার আগ্রহ কম। তারা এখনো মুক্তিযুদ্ধে নিহত-আহত ও ধর্ষিতার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে পুরনো সন্দেহটিই জারি রেখেছেন। এরই মাঝে ২০০৭ সালে অনেকটা হঠাৎই কিয়েন বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার পুনঃপর্যালোচনা’ নামে একটি সেমিনার আয়োজন করে। ফলে বিতর্কটিতে নতুন হাওয়া লাগে। এ সব ধারাপঞ্জিকে আমলে নিয়ে ২০১১ সালে বিচলার লিখলেন ‘দ্য পলিটিকস অব জেনোসাইড স্কলারশিপ : দ্যা কেইস অব বাংলাদেশ’। সেই বিতর্কের সারমর্মে তিনিও জানালেন, যতক্ষণ হতাহত ও ধর্ষিতার প্রকৃত সংখ্যা নিরাবেগে না জানা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত হয়ত ‘জেনোসাইড’ বিতর্ক চলতেই থাকবে। 

এই ধারাক্রমে ২০১৩ সালে লিখলেন গ্যারি ব্রাস। তার লেখার তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের ‘জেনোসাইড’ দাবির পক্ষে সহায়ক। আশা করা যাচ্ছিল যে, তার লেখাটির পর হলেও, আর্চার ব্লাডের টেলিগ্রামের ‘জেনোসাইড’ ইঙ্গিতকে উপজীব্য করে বাংলাদেশ বিশ্বময় ‘জেনোসাইড’ স্বীকৃতি পাবার কূটনীতিতে মনোযোগ দেবে। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ছুঁইছুঁই অবস্থায়ও আমাদের প্রশ্ন করতে হয়—বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা’ স্বীকৃতিটিই অর্জন করতে পারল না কেন?

লেখক: অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫