হাসান আলী
আপনার বয়স কত? বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ নাকি ষাট? বয়স যত কম হবে, বার্ধক্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় আপনি তত বেশি সময় পাবেন। বয়স যত বেশি হবে, বার্ধক্য মোকাবেলায় তত বেশি চ্যালেঞ্জ হবে।
আপনাকে মনে রাখতে হবে বেঁচে থাকলে অবশ্যই বুড়া হতে হবে। অথচ আপনি চান না বুড়া হতে। চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে, টাক হয়েছে, বলি রেখা ও চামড়া কুঁচকে গেছে। এসব ঢাকতে চুলে কলপ, দাঁত বাঁধা আর বাহারি ক্রিম ব্যবহার করছেন। এত কিছুর পরও আপনার বয়স বোঝা যাবে। ষাট বছরে পৌঁছার আগেই অনেকেরই ৪-৫টা রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ, বাতব্যথা, দাঁত-চোখের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তে চর্বি, ফ্যাটি লিভার, হাড়ক্ষয়, ওজন বেড়ে যাওয়া, প্রোস্টেট, ক্যান্সার, চুলকানিসহ নানারকম রোগ বার্ধক্যের শুরুতে আক্রমণ করে বসে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে বার্ধক্যকে স্বস্তিদায়ক রাখা যায়, তা জানা অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
প্রথমেই জানতে হবে পৃথিবীতে প্রবীণ জনসংখ্যা ও বৃদ্ধির হার কেমন ও আগামী দিনে প্রবীণ জনসংখ্যা কত হবে? সেই ভাবনা থাকা দরকার। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোকের সংখ্যা ছিল ২০০ মিলিয়ন। আর ২০৫০ সালে পৃথিবীতে প্রবীণ লোকের সংখ্যা হবে ১.৮ বিলিয়ন। মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ লোকপ্রবীণ হবে। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনে একজন প্রবীণ হবে। প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবীণের বসবাস হবে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে।
১৯২১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর। ২০১১ সালে মাত্র ৯০ বছর পরে গড় আয়ু হয়েছে প্রায় ৭০ বছর, ২০৫০ সাল নাগাদ গড় আয়ু হবে ৮০ বছরের কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে মানুষ ১২০ বছর থেকে ১৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণ জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রবীণ জনসংখ্যা হবে ২ কোটি ২০ লাখ। বিপুল পরিমাণ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের উল্লেখ করার মতো কোনো প্রস্তুতি নেই রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন চালু রয়েছে। ৪৯ লাখ দরিদ্র প্রবীণের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা হারে বয়স্কভাতা দেয়া হয়। ১০০ উপজেলার শত ভাগ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার ঘোষণা সরকার দিয়েছে। সরকার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩ পাস করেছে। প্রবীণ নীতিমালা-২০১৪, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা এর মধ্যেই আটকে আছে।
ভয়ংকর এক মানব সুনামি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। মানুষ সৃষ্ট এই দুর্যোগ মানব সভ্যতার চরম বিনাশ ঘটাতে পারে। আমরা সব সময়ই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি। সবার ভবিষ্যৎ নিরাপদ আনন্দদায়ক করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাই। নিজের ভবিষ্যৎ বার্ধক্য ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে চাই না। ভাবতে চাই অন্যের বার্ধক্য ও মৃত্যু নিয়ে। যেন ব্যক্তি নিজে বার্ধক্যবরণ করবেন না, সারা জীবন যৌবনেই থাকবেন। বার্ধক্য ঠেকানো যায় না; কিন্তু বিলম্বিত করা যায়, বার্ধক্যকে স্বস্তিময়-কর্মক্ষম-প্রাণবন্ত করা যায়। বার্ধক্য কোনো রোগ নয়, জীবনের একটি বিশেষ অবস্থা, যা অনিবার্য।
এখন কথা হলো বার্ধক্যে সেবা গ্রহণ কীভাবে করা যাবে? একটু খেয়াল করলে দেখবেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা জীবিত থাকলে মাতা পিতাকে সেবা দিয়ে থাকেন। যদিও মাতা নিজে প্রবীণ। পিতার চেয়ে মাতার বয়স কম থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিতাই আগে মারা যান। বৃদ্ধা মা চরম অবহেলার শিকার হন। খাবার-ওষুধ-বিছানার সেবার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না। পরিবারের সদস্যদের করুণা আর দয়ার ওপর নির্ভর করে অনাদর, অবহেলা নিয়ে বার্ধক্য যাপন করতে হয়। প্রবীণের সেবা পাওয়া অধিকার। এটি করুণা হতে পারে না। প্রবীণ যৌবনে দেশের জন্য ও পরিবারের জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন। অতএব, তার দেখাশোনা সেবাযত্ন করা নবীনদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সাধারণত প্রবীণকে বাড়িতে পরিবারের সদস্যরা সেবা দেয়। কখনো প্রতিবেশীরা এক-আধটু সেবা করেন।
অনেক প্রবীণ আছেন যারা শুধু ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করে থাকেন। প্রবীণের সেবা বলতে আমরা বুঝবো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; খাবার, ওষুধ, বিছানা, কাপড়-চোপড়, গোসল, চলাফেরায় সহানুভূতিশীল ইতিবাচক আচরণ করা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা, আপনজনদের সঙ্গে চাহিদা মোতাবেক দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, শারীরিক পরিশ্রমে সহায়তা করা। যেমন হাঁটা, চলাফেরা, বাগান করা, ছোটখাটো পারিবারিক কাজে সাহায্য করা, বিয়ে বাড়ি, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উৎসাহিত করা; সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখা- এসবই প্রবীণের সেবার মধ্যে পড়ে। এ ধরনের সেবাগুলো অব্যাহত থাকলে একজন প্রবীণ ৭০-৮০ বছরেও মোটামুটি কর্মক্ষম থাকতে পারবেন। যেমন- তিনি নিজেই নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো করবেন, কারও সাহায্য ছাড়াই চলতে ফিরতে পারবেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবেন। মানুষের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন।
এভাবেই একজন প্রবীণ কর্মক্ষম জীবনযাপন করতে পারবেন। প্রবীণের কর্মক্ষম শান্তিপূর্ণ জীবন হলে কী লাভ। অল্পসেবা, অল্প ওষুধ, অল্প যত্নতেই হবে। ফলে সময়, টাকা বাঁচবে, মানসিক চাপ কমবে। প্রবীণরা যদি একত্র হন, তাদের প্রয়োজনীয় অধিকারগুলোর জন্য সোচ্চার হন, তবে সরকারও এসব নিয়ে আরো বেশি ভাববে। আমাদের প্রবীণ যেন আমাদের শ্রদ্ধার-ভালোবাসার পাত্র হন, মনে প্রাণে তাই কামনা করি।
লেখক: বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ