Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বিজয়ের ৪৯ বছর: পঁচিশে মার্চের পর

Icon

আনোয়ার পাশা

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৯

বিজয়ের ৪৯ বছর: পঁচিশে মার্চের পর

ড. দেবকে ও তার পুত্রকে একই সারিতে দাঁড়িয়ে দিয়ে ওরা গুলি করে। পাশাপাশি লুটিয়ে পড়ে দুটি দেহ। ওরা পিতা-পুত্র। কিন্তু রক্তের মিল ছিল কোথায়? ওদের রক্তের মিল হয়েছে ওদের মৃত্যুর পর। 

এমনি রক্তের মিল হয়েছিল আরো দুজনের। দুজন প্রখ্যাত অধ্যাপক পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান ও ইংরেজি বিভাগের রীডার ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দুটি ভিন্ন ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন। নিজ নিজ ধর্মে দু’জনেরই নিষ্ঠা ছিল প্রবল। পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দুজনকে গুলি করা হলে রক্তের ধারা মিশে গিয়েছিল।

সিমেন্ট বাঁধানো মেঝেতে সেই মিশে যাওয়া রক্তের জমাটবদ্ধতা অনেকেই তো দেখেছিলেন। দেখেছিলেন সুদীপ্ত কিন্তু সে রক্তের কোন অংশ মুসলমানের, আর কোনটুকুই বা হিন্দুর তা কি চেনা গিয়েছিল?

আর কতো মর্মান্তিক ছিল সেই দৃশ্য- সেই রক্তমাখা পায়ের ছাপ। একাধিক পায়ের অনেক ছাপ পড়েছে কংক্রিট-বাঁধানো আসা-যাওয়ার পথের উপর। সে যেন দেখা যায় না। কিন্তু যা দেখা যায় না তা-ই যে ঘুরে ঘুরে দেখতে হচ্ছে সারাক্ষণ।

শহীদ মিনারের সামনে এতো কী দেখার ছিল সুদীপ্তর? চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে শহীদ মিনার। বিচূর্ণীকৃত শহীদ মিনারের সামনে সুদীপ্ত কাল সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল ফিরোজের আহবানে। মাত্র গতকালের কথা। কিন্তু সুদীপ্তর এখন মনে হচ্ছে সে কথা কত কালের। গাড়িতে উঠবার সময় সুদীপ্ত কোনো কথা বলেন নি। কেবল ফিরোজ বলেছিলেন- ‘যাক, তোমাকে পেলাম তা’হলে।’

সুদীপ্তকে যে পাওয়া যাবে ফিরোজ সে আশা করেননি। ফিরতি পথে তিনি তখন সুদীপ্তর সন্ধানেই যাচ্ছিলেন। আর ভাবছিলেন, ওরা কি আছে! কী অবস্থায় না জানি দেখতে হবে ওদেরকে! ভাবতে ভাবতেই সুদীপ্তকে সামনে পেয়েছিলেন। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

এই জন্যই পাগলটার সাথে এতো বন্ধুত্ব ফিরোজের। কী কা- দেখ দেখি। ছত্রিশ ঘণ্টা কারফিউয়ের পর কোথায় বৌ-ছেলে ফেলে শহীদ মিনারের সামনে এখন কাঁদতে এসেছে। শহীদ মিনারের শোকটাই তার কাছে বড়ো হয়েছে। কিন্তু অস্বাভাবিক হয়েছে কি? একটুও না। শুধু সুদীপ্ত কেন। কোন বাঙালি আজ এই পথে যেতে চোখের পানি মুছছে না? মেডিক্যাল কলেজের পথে এইখানে ফিরোজও তো কেঁদে গিয়েছেন তখন।

কিন্তু কি আর দেখবেন তারা। কিছুই দেখার ছিল না। ছিল শুধু রক্ত, রক্তের ছাপ, রক্তের বন্যা। প্রবেশ-পথের প্রশস্ত চাতালের মধ্যে এক চুল স্থানও পাওয়া গেল না যা রক্ত প্লাবিত নয়। সদর রাস্তা থেকে প্রবেশ-দ্বার পর্যন্ত পথটুকু সবটাই রক্ত-চিহ্নিত। রক্তের ধারা গড়িয়ে গেছে নর্দমায়।

ফিরোজের দুর্ভাগ্য। গুহঠাকুরতা স্যারের পুরো সংবাদ পান নি। পেলে এখানে আসতেন না। যেতেন হাসপাতালে। হাসপাতালে ঢুকলে দেখতেন, স্যার তখন দিব্যি কথা বলছেন। শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে গেছে, কিন্তু কথা বলতে পারছেন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা ব্যক্ত করছে

‘বোধ হয় উঠতে আর পারবো না। শুয়ে বসে কাটাতে হবে। ঠিক আছে। ব’সে ব’সে বই লিখব। তাতেই চলে যাবে আমাদের।’

কিন্তু হায় চলতে দিচ্ছে কে? মাত্র কয়েক ঘণ্টার ওপারে মানব জীবনের চরম ঘটনাটি তখন প্রতীক্ষা করছে তার জন্য। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈনিকেরা রাতেই যে কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিল তা সম্পন্ন হয়েছিল দিন দুই তিন পর। হাঁ, ইয়াহিয়ার পিচাশ সৈনিক একেবারে সাবাড় ক’রে দেওয়ার জন্যই গুলি করেছিল গুহঠাকুরতা স্যারকে। কিন্তু গুলি তাঁর ঠিক জায়গায় লাগে নি। তা হলেও সে রাতে কি রক্ষা পাওয়ার উপায় ছিল? সর্বত্রই মৃতদেহ তারা রাখেন। কোথাও কোথাও গর্ত করে আশেপাশের লাশগুলিকে তারা মাটি-চাপা দিয়েছিল। কেবলি লাশগুলিকে? ওরে বাবা, তাহলে রক্ষে থাকবে কিছু? সেনাপতি চেয়েছেন, কাউকে আধ-মরা ক’রে ফেলে রাখা চলবে না। বাঙালি তবে আবার বেঁচে উঠে হাঙ্গামা শুরু করবে। অতএব একেবারে সব মেরে লাশ বানিয়ে দাও সৈনিকদের শকুন-দৃষ্টিতে সে রাতে, তাই, আহত ব’লে কিছু ছিল না, ছিল কেবল লাশ। সে রাতে আহত-নিহত নির্বিচারে সকলকে পুঁতে দিয়ে অভূতপূর্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানিরা। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও তাঁর পুত্রসহ অন্য দু’জন আত্মীয়ের মৃতদেহ যখন টেনে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ হল-প্রাঙ্গণে গর্তে মাটি-চাপা দেয়া হয়েছিল তখন কি আহত অধ্যাপক গুহঠাকুরতা অব্যাহতি পেতেন ওদের হাতে? কিন্তু হায় অব্যাহতি পেয়ে লাভ কী হ’ল? তাঁকে রাখা তো গেল না। এ বেদনা কী ক’রে বহন করবেন বাসন্তী দি।

অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা- গেন্ডারিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। ঐ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রীর জন্য নিজস্ব বাসভবন আছে। সেখানেই তাঁরা থাকতেন এতকাল। স্ত্রীর সুবিধার জন্য স্বামী অসুবিধা ভোগ করেছেন দীর্ঘকাল। সুদূর গেন্ডারিয়া থেকে নীলক্ষেত আসা-যাওয়া করেছেন। অতঃপর ড. গুহঠাকুরতা জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হ’লে তারা উঠে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে। এই তো কয়েক মাস মাত্র আগে এসেছেন। যদি সেখানেই থেকে যেতেন তারা। কিন্তু গেন্ডারিয়াতেই কি হত্যাকা- বাদ গেছে নাকি! না, সে স্থানও নিরাপদ ছিল না। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান পূর্বে যে তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনে একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন সেটাই কি নিরাপদ ছিল? তবু অনেকেই বলেছেন, বাসা বদল না করলে ওদের এই বিপত্তি ঘটত না। ও সব কথা লোকেই বলে। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী বলেন না। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর মতো অমন মহীয়সী তেজস্বিনী মহিলা হয় না- কথাটা বাসন্তী দির। তাঁর কথা মনে হ’লে বাসন্তী দির সারা মন কৃতজ্ঞতায় ভ’রে উঠে অত সাহস তিনি পেয়েছিলেন কোথায়? তাঁর বাড়ির সকলকেই তো ওরা মেরেছিল- তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, স্বামী, স্বামীর ছোট ভাই এবং একটি ভাইপো- কেউ রেহাই পায়নি। কোলের শিশুপুত্র নিয়ে কেবল বেঁচেছিলেন তিনি নিজে। আর বেঁচেছিল একটি বিবাহযোগ্য কন্যা- তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। দুর্বৃত্তদের নজরে পড়ে নি। বড় ছেলে এ বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দিত। সেই ছেলেকেও যখন ওরা মারলে তখন কি আর মাথা ঠিক থাকার কথা। কিন্তু তবু ঠিক রেখেছিলেন মহিলা। বেঁচে যাওয়া শিশু-পুত্রটি মায়ের সঙ্গে পিছে পিছে এসে মাকে প্রশ্ন করেছিল- 

“আব্বা ভাইয়া ওরা সব এখানে শুয়েছে কেন আম্মা?”

সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে ছেলেকে বুকে নিয়ে হু হু করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছিলেন বেগম মনিরুজ্জামান। বাপ রে তোর জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে। মনে মনে বলেছিলেন। এবং তখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হন নি।

দুর্বৃত্তরা স্বামী-সন্তানকে এই রাতে নিচে নিয়ে গেল কি মারবার জন্য?- নিজের ফ্ল্যাটে কিছুক্ষণ বড়ো অস্থির হয়ে এ-ঘর ও-ঘর করেছিলেন। তারপর একাই নিচে নেমে এসেছিলেন- তাঁদের তিন তলার ফ্ল্যাট থেকে এক তলায়। তখনি কখন মায়ের সঙ্গে পিছে পিছে এসেছিল চার বছরের সেই শিশু-পুত্র।

নিচে সেই দৃশ্য দেখে একটুও অবাক হন নি বেগম মনিরুজ্জামান। তাঁরা পাঁচজন প’ড়ে আছেন। প্রবেশ-পথের রক্তধৌত প্রশস্ত চাতালে প’ড়ে দু’ একজন তখনও কাতরাচ্ছেন। কারা তাঁরা?-এ প্রশ্ন মনে না তুলে সেই মুহূর্তেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উপরে। এক বোতল পানি ও চামচ নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বুকের মানিক বড়ো ছেলেটি তাকাচ্ছে তখনও। মাকে দেখে চোখ দু’টো একটু বড়ো-বড়ো হ’ল শুধু। তার পরেই সে যে চোখ বন্ধ করল আর তা খোলে নি কখনো। মা তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন মুখে। কিন্তু খেতে পারে নি। গাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল। বুকের স্তন্য দানে যাকে মানুষ করেছিলেন, মৃত্যুকালে একটু পানি পর্যন্ত তাকে খাওয়ানোর সুযোগ পেলেন না- ছেলে চ’লে গেল। কিন্তু ওই ভদ্রলোক তো বেঁচে আছেন- নিচের তলার সেই হিন্দু অধ্যাপকটি জল চাইছেন। পর্দানশীল মহিলা। কখনো সামনে যান নি। কিন্তু এখন তাকে কতো কালের চেনা ভাইয়ের মতো মনে হ’ল। কাছে গিয়ে চামচ দিয়ে জল দিলেন মুখে। কয়েক চামচ খাওয়ানোর পরই মনে হ’ল এখনো তো এঁর বাঁচার সম্ভাবনা আছে। তখনি গিয়ে কপাটে ধাক্কা দিলেন-

‘দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন।’

কথাগুলি বাসন্তী দি কখনও ভোলেন নি। সেই দুর্যোগের রাতে স্বামীকে ধ’রে নিয়ে গেলে একমাত্র কিশোরী কন্যাকে বুকে নিয়ে বাসন্তী দি যখন অতি মাত্রায় অসহায় বোধ করেছিলেন ঠিক তখনই যেন তাঁর বোনের ছদ্মবেশে কোন দেবী এসে তাঁকে ডাক দিলেন- দিদি বের হন, আপনার সাহেব এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু আরো কি একটা কথা বলল যেন- আমার সাহেব মারা গেছেন। বোন আমার, এ তুই কী শোনালি। হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল বাসন্তী দির বুকের ভিতরটা।

বাসন্তী দি কয়েকবার ডাক দিতেই তাঁর গাড়ির ড্রাইভার সাহস ক’রে বেরিয়ে এসেছিল। গ্যারেজের উপর তলার একটি কামরায় সে থাকত। তার সাহায্যে মা ও মেয়েতে মিলে স্বামীকে ঘরে তুলেছিলেন তাঁরা।

অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার জওয়ানরা এসেছিল। ধ’রে এনেছিল বস্তির কয়েকজন লোক। লাশগুলি টেনে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছিল তাদের উপর। হায় হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক- একটি বিভাগের প্রধান তাঁর ঠ্যাং ধরে এমনি ক’রে টানতে টানতে নিয়ে গেল। তিনি জানলা দিয়ে দেখলেন। বস্তিবাসীদের দোষ ছিল না। তারা ধরাধরি ক’রে নিয়ে যেতে চেয়েছিল; কিন্তু চাওয়ার তারে কোন মূল্য আছে? বর্বরদের গুঁতোর চোটে তাদেরকেও বর্বর কাম করতে হয়েছিল। তবু শেষ রক্ষা হয় নি। তাঁরা বাঁচেনি একজনও।

জগন্নাথ হলের মাঠে আরো অনেকগুলি বস্তিবাসী বিভিন্ন দিক থেকে মৃতদেহ কুড়িয়ে এনে একত্রে জড়ো করছিল। তাদের পিছে পিছে সঙ্গিন উঁচিয়ে এসেছিল জওয়ানেরা। অতঃপর হুকুম হয়েছিল গর্ত কর। ঝুড়ি কোদাল কোথা থেকে জওয়ানেরাই দিয়েছিল এবং সে জওয়ানদেরকে খুবই কষ্ট করে কয়েক ঘণ্টা অনবরত প্রবল গালি ও বুটের লাথি চালাতে হয়েছিল। তবেই না শেষ পর্যন্ত মনমত হয়েছিল গর্তটা। তখনও কাতরাচ্ছে এমন কিছু আহত ব্যক্তিকেও অনেক শবের সঙ্গে সেই গর্তে ফেলে দেওয়ার পর এসেছিল বস্তিবাসীদের পালা। লম্বা গর্তটার পাশে তাদেরকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে ব’লে জওয়ানরা চাঁদমারি অভ্যাস করেছিল। একটি একটি করে সব ক’টি বস্তিবাসী গর্তে পড়ে গেলে বাকি কাজটুকু করতে হয়েছিল জওয়ানদের। পাশের স্তূপীকৃত মাটি ঠেলে দিয়ে জায়গাটা ভরাট করতে হয়েছিল তাদেরকে।

জায়গাটা সুদীপ্ত ও ফিরোজ দেখলেন। চৌত্রিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে এখানেই এলেন তারা। একটু আগেই ফিরোজ এ স্থানের কথা শুনে এসেছেন এবং স্বচক্ষে জায়গাটা দেখবেন বলে মন ঠিক ক’রেই এদিকে এসেছেন। না, এখানে তো সেই ভয়টা নেই।

(মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত থেকে অংশবিশেষ)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫