Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল

Icon

শামসুজ্জামান মিলন

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৪৬

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল

পাকিস্তানি শাসকচক্র ১৯৬৮ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের এক দশক (১৯৫৮-৬৮), উন্নয়ন দশক হিসেবে পালন করার জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছিল। অন্যদিকে বিরোধী শক্তিসমূহ স্বৈরাচারের কালো দশক হিসেবে চিহ্নিত করে এই সময়কালকে। 

আইয়ুব খানের ১০ বছরের স্বৈরশাসনে পূর্ব বাংলা এবং পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ও দখলদার শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণকে নিপীড়নের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়েছিল।

এর মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন। তবু ১৯৬৮-৬৯-এর আগে ব্যাপক গণভিত্তিক সংগ্রাম গড়ে ওঠেনি প্রধানত চরম জুলুম নির্যাতনের কারণে।

১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী পল্টনে জনসভা শেষে লাট ভবন ঘেরাও করেন এবং পরদিন ৭ ডিসেম্বর হরতালের ডাক দেন। ৭ এবং ৮ ডিসেম্বর পরপর দু’দিন হরতাল পালিত হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় জনতা-পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ গুলি চালায়। কয়েকজন শহীদ হন। এরপর মওলানা ভাসানী সমগ্র পূর্ব বাংলার হাটবাজারে হরতালের ডাক দেন। ২৯ ডিসেম্বর ছিল ঘোষিত হাট হরতাল।


আসাদের শার্ট
শামসুর রাহমান 

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়েছে হাওয়ায় নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যূর আনাচে-কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলার রাজনীতি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করেছিল। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। আরও আসামি করা হয়েছিল ৩৫ জন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক আমলাকে। বাঙালি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে মওলানা ভাসানীই ছিলেন বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একমাত্র ভরসা। এ অবস্থায় মওলানা ভাসানী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলনের সূচনা করেন, যা আসাদুজ্জামানের শাহাদৎ বরণের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল।

হাতিরদিয়া হাট হরতাল
হাতিরদিয়া বর্তমান নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার একটি পুরাতন নদীবন্দর এবং একটি বড় হাট। এটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। প্রতি রোববার এ হাট অনুষ্ঠিত হতো। মনোহরদী, শিবপুর, বেলাবো, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী অঞ্চলের বেপারি-ব্যবসায়ীসহ হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে এই হাটে।

হরতালের তারিখ ছিল ২৯ ডিসেম্বর। হাট-বাজারে হরতাল কর্মসূচি গ্রহণের পর নরসিংদী জেলার সবচেয়ে বড় হাট হাতিরদিয়া হরতাল পালনের জন্য প্রধানত শিবপুর-মনোহরদী এলাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), কৃষক সমিতি ও ন্যাপের (ভাসানী) কর্মীরা এগিয়ে আসেন। তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও কৃষক জনগণকে হরতাল পালনে উদ্বুদ্ধ করতে। এই সময়কার উল্লেখযোগ্য সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান, তোফাজ্জেল হোসেন, তোফাজ্জেল হোসেন ভূঁইয়া শাহজাহান, আওলাদ হোসেন খান, আবদুল মান্নান খান, হযরত আলী, আব্দুল গফুর, শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, বদরুজ্জামান সেন্টু, আবদুর রহিম, আবদুর রশিদ মোল্লা, শামসুজ্জামান মিলন, জসিমউদ্দিন খোকা ও আমানুল্লাহ।

২৯ ডিসেম্বর রোববার সকাল থেকেই মাইকযোগে হরতালের পক্ষে পিকেটিং শুরু হয়। গরুর বাজার আর পাটের হাটের জন্য প্রসিদ্ধ হাতিরদিয়া। হাতিরদিয়া হাট হরতাল আশপাশের কয়েকটি থানার জনগণকে আইয়ুব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ ও জোরদার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল।

যথারীতি সকাল থেকেই হরতালের সপক্ষে জনগণ ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং হাটের সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। দূর-দূরান্তের বেপারি ব্যবসায়ীরা হাটের বাইরে মাঠে-ময়দানে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু দোকান বসিয়েছিল।

শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনকালে এলাকার সরকারদলীয় লোকজন পুলিশের সাহায্য চায়। দুপুর দুইটার দিকে হাতিরদিয়ায় রিজার্ভ পুলিশ পৌঁছায়। পুলিশ এসেই পিকেটিংরত চারজনকে গ্রেফতার করে এবং রাইফেলের বাঁট দিয়ে আসাদুজ্জামানের মাথায় আঘাত করে। আসাদ পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন। আসাদের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়েছিল এবং ধস্তাধস্তিতে তার শার্টের বোতামগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল। গ্রেফতার ও আসাদকে আহত করার ঘটনা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আহত আসাদুজ্জামান মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হাতিরদিয়া বাজারের পূর্ব পাশের মাঠের পুকুরপাড়ে এক তাৎক্ষণিক জমায়েতে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন এবং গ্রেফতারকৃত সহযোদ্ধাদের মুক্ত করার জন্য কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ে অগ্রসর হন। 

বিক্ষুব্ধ জনতা ইট, পাথর, লাঠি নিয়ে পুলিশের আশ্রয়স্থল ঘেরাও করে সহযোদ্ধাদের মুক্ত করার জন্য। এমনই এক পরিস্থিতিতে পুলিশ জানালা দিয়ে জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সিদ্দিক মাস্টার (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), মিয়া চাঁন (গরিব কৃষক), হাসান আলী (গরিব কৃষক)। আবদুল হাইসহ ৮/১০ জন গুরুতর আহত হন। আবদুল হাইকে আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।

হাতিরদিয়া হাট হরতালের হত্যাকাণ্ডে যেন একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে সারাবাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এলাকায় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পুলিশের গুলিবর্ষণ ও মানুষ হত্যা এলাকার জনগণকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

পুলিশের হত্যাকাণ্ডের খবর পত্রপত্রিকায় জানানোর জন্য আহত আসাদ একটি সাইকেলে করে ঘোড়াশাল রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমথ্যে প্রচণ্ড শীত, রক্তক্ষরণ, ক্ষুধা এবং কয়েকজন সহকর্মীর মৃত্যুতে শোকাহত আসাদ অচেতন হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। একজন পরিচিত লোক আসাদকে শুশ্রুষা করেন, গরম দুধ খাওয়ান। একটু পরে আসাদ সুস্থ হয়ে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ঢাকা এসে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন এবং সাংবাদিক নির্মল সেন ও আবদুল হালিমের কাছে পুলিশি বর্বরতার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন।

২৯ ডিসেম্বরের হাট হরতালের মাত্র ২২ দিন পর ২০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন আসাদুজ্জামান। আসাদ শহীদ হওয়ার পর সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘আসাদ খবর নিয়ে এসেছিলেন হাতিরদিয়ার পুলিশি গুলি ও হত্যার, এবার আসাদ নিজেই খবর হয়ে এলেন।’

২৯ ডিসেম্বরের হাট হরতাল ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের এক মাইলফলক। ওই দিন যশোরের নড়াইল এবং পাবনার আটঘরিয়ায় পুলিশের গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন চলেছিল। ২৯ ডিসেম্বরের রক্ত যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজকে নতুন দিশার নির্দেশ দেয় এবং ঐকব্যদ্ধ করে আইয়ুবের স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে। হাতিরদিয়ার হাট হরতালে কৃষক শিক্ষক ছাত্রের জমাট বাঁধা রক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। হাতিরদিয়া হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারাদেশে স্লোগান গান ওঠে ‘ইতিহাসে দুটি নাম হাতিরদিয়া আর ভিয়েতনাম’। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এসএসএফ-দোলন)- এই চারটি ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে রচনা করেছিল ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি। এই কর্মসূচিটি ছিল মূলত পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করা এবং শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করার লক্ষ্যে। ১১ দফার দুর্বার আন্দোলনে ২০ জানুয়ারি (১৯৬৯) ছাত্রনেতা হাতিরদিয়া হাট হরতালের নায়ক আসাদুজ্জামান শহীদ হন। সারা বাংলা অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়। সারা দেশের আকাশে-বাতাসে একটি স্লোগান উচ্চারিত হয় ‘আসাদ ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’। ২৪ জানুয়ারি কিশোর মতিউর ও রুস্তম আলীর জীবনদানের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।

লেখক: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক ছাত্রনেতা

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫