
শেখর দত্ত
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অর্থনীতি আমাদের এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তার উপযোগী ও সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো সেই গতিতে অগ্রসর হচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে সিটি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ভালো একটা লক্ষণ আর বিশেষভাবে কাউন্সিলার পদে নির্বাচন থাকায় ভোট প্রদানের হারও সম্মানজনকভাবে হচ্ছে।
তবে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য-অবিতর্কিত নির্বাচনের ধারায় আমরা ফিরে যেতে পারছি না। এই যে পারছি না এটাই হচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা
করোনা দুর্যোগের সূচনার সেই অভাবিত দিনগুলোতে নিজের লেখা পত্রিকার কলামগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে পত্রিকায় বা ফেসবুকে অন্যদের লেখা ও মন্তব্যগুলোও মনে করার চেষ্টা করছিলাম। অতিমারি-মহামারি, খাদ্যভাব-দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে শুরু করে সরকার ও সমাজের সীমাবদ্ধতা-অব্যবস্থা প্রভৃতি সামনে এনে কত কিছু নিয়ে যে তখন আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। কোনো কোনো লেখা বা মন্তব্যে তখন মনটা ভারাক্রান্ত, বিরূপ হয়েছিল।
বিপদ কেটে না গেলেও আজ যখন জীবন-জীবিকা অনেকটাই স্বাভাবিক হতে চলেছে, করোনার টিকাও যখন এসে গেছে; তখন ওইসব ভাবতে গিয়ে মনে হলো, দুর্যোগ সামনে আসতে পারে ভেবে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের ওইসব প্রকাশিত আলোচনা-সমালোচনার মূল্য অপরিসীম। কেননা দুর্যোগের সময় কিংবা মন্দ-ভালো কোনো ইস্যু সামনে আসলে জনগণের বিভিন্ন অংশ বিশেষত জনগণের চিন্তা-ভাবনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিরূপতা-বিক্ষুব্ধতা, সংকল্প-দৃঢ়তা প্রভৃতি যতই প্রকাশিত হবে; ততই রাষ্ট্র-সমাজ ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার জন্য মঙ্গলজনক হবে। জনগণের কর্মপ্রেরণা-কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতার অনেকটাই নির্ভর করে, তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারার ওপরে।
ওই সময়ের এবং এমনকি এখনকার দিনগুলোর দিকে যদি গভীর মনোযোগ নিয়ে তাকানো যায়, তবে লক্ষ্য করা যাবে, করোনার সময় লকডাউনের মাধ্যমে আমাদের জীবন ও জীবিকার পথ রূদ্ধ করে দিতে যতই উদ্যোগী হয়েছে, ততই মরিয়া হয়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছে। অজ্ঞানতা, অন্ধত্বের কারণে জনগণের বড় অংশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা অবশ্যই সমালোচনা বা সংশোধনযোগ্য। আবার সেই গণ্ডি ভেঙে ফেলার কর্তব্যও রয়েছে জাতির সামনে; কিন্তু তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যে আকাঙ্খা ও প্রচেষ্টা তার মূল্য ছিল অপরিসীম। সর্বোপরি করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত ধারণাও কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব এখন আলোচনায় কম আসছে, মাস্ক ৯০/৯৫ শতাংশ গ্যারান্টি দেয় কথাটি এখন প্রতিষ্ঠিত।
সরকারই জাতীয়-আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে সব খুলে দিচ্ছে। সম্প্রতি প্রয়াত অলি আহাদের কন্যা বিএনপির এমপি রুমিন ফারহানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সমালোচনা করে সংসদে বলেন, ‘সরকারের এ ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল দিবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।’ কথাটি এভাবে বলা কতটুকু সঙ্গত- এই প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, কিছুদিন আগেও স্কুল-কলেজ খুলে দিলে কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আর সমালোচনা হতো? কথা বলা সহজ ও এটিতে অনেক সময় জনপ্রিয়তাও জোটে; কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা কঠিন। যারা হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন প্রতিষ্ঠা করে বিদ্যুৎকে খাম্বায় রূপ দিয়েছিল, জেট ফুয়েলকে কেরোসিন বানিয়েছিল, খাদ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি, কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করেছিল; সেই দলের কারও মুখে আসলে এমন কথা মানায় না। বাস্তবে আমাদের দেখতে হবে কোথায় কোথায় জাতি হিসেবে আমরা সক্ষমতা-সফলতা অর্জন করেছি আর কোথায় কোথায় আমাদের রয়েছে দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা এবং কোন বৃত্তকে আমরা ভেঙে অগ্রযাত্রার নতুন দিগন্তকে উন্মোচিত করতে পেরেছি- এই হিসাবটাই প্রতিনিয়ত যথাযথভাবে স্মরণ করতে হবে।
করোনা দুর্যোগের শুরুতে জীবন-মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছেন কতজন? করোনার প্রথম দিকে খবরে জানলাম, করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েছে পদ্মা সেতুর কাজে। নববর্ষ উদযাপনের ছুটি কাটিয়ে চীন থেকে ফিরেছেন স্বল্পসংখ্যক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। ৬শ’ প্রকৌশলী আটকা পড়েছেন সেখানে। পরে জানা গেল, করোনায় থেমে নেই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ এলো সেই শুভক্ষণ। জানা গেল, ৪১তম সর্বশেষ স্প্যান বসানোর কাজ শেষ। কীর্তিনাশা পদ্মাকে কীর্তিময় করে তোলার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জিং কাজের সমাপ্তি ঘটেছে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, তা নিয়ে কতটাই না বিরূপ মন্তব্য হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ে শোরগোল তোলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর মধ্যে ছিল রাজনীতি। দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী পেছনে লেগেছিলেন! ভেঙে পড়বে পদ্মা সেতু এমন ধরনের কথা পর্যন্ত বলেছেন দেশের দু’বারের প্রধানমন্ত্রী! এতদসত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা সরকার রেখেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে জাতির সক্ষমতা অর্জন করার ভেতর দিয়ে নয় কি! জাতি হিসাবে নিজেদের সাফল্য নিজেরা দেখতে পারি কি আমরা?
এখনো মনে পড়ে সেই ছাত্রাবস্থায় মিসরের আসোয়ান বাঁধের কথা। ওই ঘটনা তখন আমাদের কিশোর মনে দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে জাগ্রত করেছে। কিন্তু এখন! নিজেরা যখন করে ফেললাম পদ্মা সেতু, তখন আমাদের কিশোর-তরুণদের উজ্জীবিত হবার কথা। আরও অনুপ্রাণিত হলাম, ২১ জানুয়ারি সংসদে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে সেতুটির নাম রাখা হোক। তিনি প্রথমে হাত নেড়ে এবং পরে মাথা ও ঘাড় নেড়ে তাতে অমত প্রকাশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি গর্বের বিষয়। কথায় বা নামকরণে নয়, কাজের ভেতর দিয়েই একজন রাজনীতিক বেঁচে থাকেন।
করোনা দুর্যোগের মধ্যে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী আশ্রয়ন প্রকল্প অগ্রসর হচ্ছে এটা জানতাম; কিন্তু বিস্মিত হলাম ২৩ জানুয়ারি এই কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখে। আরও উৎসাহিত হয়েছি দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন দেখে। কি যত্নেই না ওগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। ৬৬ হাজার ১৬৯ টি পরিবারকে গৃহ ও জমি এবং ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে ৩ হাজার ৭১৫টি তথা ৭০ হাজার পরিবারকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি ছিল ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে বিধবা ভাতা, দুস্থ ভাতা প্রভৃতি কর্মসূচির পরিণত রূপ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর কথামতো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে এই কর্মসূচি উৎসর্গীকৃত। কখনও মনে হয়, রাষ্ট্র ও সমাজে নৈতিকতার ধসটাই কেবল দেখতে আমরা অভ্যস্ত; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকের এই উত্থান দেখা ও দেখানোটা কি আমাদের দেশপ্রেমিক কর্তব্য নয়!
এরই মধ্যে করোনার টিকা পাওয়ার ঘটনা এবং তা প্রদানের কর্মযজ্ঞের কথা এখানে না বললেই নয়। কত যে সোরগোল হলো টিকা পাওয়া যাবে না, ভারত কথা রেখে আমাদের টিকা দেবে না। আর এখন প্রচার শুরু হয়েছে মানসম্মত নয় বলে। ইতিমধ্যে বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, ‘করোনার টিকায় মানুষের আস্থা নেই। সন্দেহ আছে।’ এই কথা বলার আগে অন্তত আয়নায় মুখ দেখে নিজেদের প্রশ্ন তোলা উচিত, বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি জনগণের কথা দূরে থাকুক, দলীয় নেতা-কর্মীদের আস্থা ও বিশ্বাস আছে কি? যদি আদৌ নিজেদের প্রতি নিজেদের বিশ্বাস থাকতো, নৈতিক বলে বলীয়ান হতো; তবে দলীয় নেতা তারেক রহমান বিদেশে পালিয়ে যেতেন না এবং এখনো পড়ে থাকতেন না।
করোনা দুর্যোগের মধ্যেও উল্লিখিত ও অনুল্লেখিত অনেক অর্জনের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে সিটি নির্বাচন হচ্ছে। তবে এটাই বাস্তব, নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনা অহরহ শুনতে বা পড়তে হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অর্থনীতি আমাদের এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তার উপযোগী ও সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো সেই গতিতে অগ্রসর হচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে সিটি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ভালো একটা লক্ষণ আর বিশেষভাবে কাউন্সিলার পদে নির্বাচন থাকায় ভোট প্রদানের হারও সম্মানজনকভাবে হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য-অবিতর্কিত নির্বাচনের ধারায় আমরা ফিরে যেতে পারছি না। এই যে পারছি না এটাই হচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা।
তাই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এটাই হবে সরকার ও সরকারি দলের জন্য চ্যালেঞ্জ যে, আগামী নির্বাচনকে অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা। সংসদের ভেতরে-বাইরের বিরোধী দলগুলোকেও এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে একাত্ম হওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই। দেশের লাভ সবার লাভ, এই চেতনাই মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পালনকালে সংশ্লিষ্ট সব দল-ব্যক্তি-গোষ্ঠী-মহলকে আলোকিত করুক, এটাই একান্ত কামনা।
- কলাম লেখক, রাজনীতিক