গৌরবমণ্ডিত ছাত্রসমাজ আবার গণতন্ত্রের লড়াইয়ে থাকুক

মনজুরুল হক
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৩

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন সামরিক শাসকের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শহীদ হওয়া জয়নালের মরদেহ ঘিরে আছেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহযোদ্ধারা
১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ যেমন টুপ করে আকাশ থেকে পড়েনি, ১৯৪৭ থেকেই একটু একটু করে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-হতাশা থেকে উদ্বেলিত হয়েছে এবং ’৭০-এর নির্বাচনের পর পরই বিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল; তেমনি ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানও রাতারাতি সংঘটিত হয়নি।
১৯৮২ সালে সেনা শাসক এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর পরই বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। তবে সেটি ’৮৩-এর আগে তেমন বড় কোনো ঘটনার জন্ম দিতে পারেনি।
১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর ছিল জেল হত্যা দিবস। এদিন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশি বাধায় তা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার গণঅভ্যুত্থান দিবসে, ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ কলাভবনে ও ভবনের বাইরে বিক্ষোভ মিছিল করে। এই মিছিলে পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় ও সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত ও গ্রেফতার হন।
বিকেলে সিদ্ধান্ত হয়- ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পুলিশ প্রবেশ করতে পারবে না। ক্যাম্পাসকে ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘোষণা করা হয়।
এর আগে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের কোনো দফা ছিল না। মোটের ওপর সামরিক শাসন-বিরোধী ভূমিকা রাখার জন্যই পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ৮ নভেম্বর তিন দফা দাবিকে সামনে রেখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে- ১. মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল; ২. সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তিদান এবং ৩. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
এই লক্ষ্য সামনে রেখে ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সেদিন সকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী যখন বটতলায় সমবেত হয়, তখন কেন্দ্রীয় নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতাদের ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানান- অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না। এর পর পরই অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন করেন- কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সামরিক স্বৈরাচারের টিয়ার শেল, গুলি উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সমবেত হয়েছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে নেমেছিল।
সে সময় ছাত্র-জনতার বিপ্লবী ভূমিকা ছিল। গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মূলত ছাত্র-ছাত্রীরা ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচিতে শামিল হন। বীরদর্পে ছাত্রসমাজ কার্জন হলের সামনে জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে, কিন্তু পুলিশ সেই দুর্বার আন্দোলন, অপ্রতিরোধ্য মিছিল প্রতিরোধ করতে পারেনি। শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জল-কামান আর বেধড়ক লাঠিচার্জ। শেষে ঠান্ডা মাথায় গুলির নির্দেশ। নির্বিচারে গুলি চলে। প্রথম চোটেই নিহত হন দীপালী। হতাহত হয়ে লুটিয়ে পড়েন অনেকে, যাদের লাশ গুম করা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়; কিন্তু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিহীনতা কিংবা আপসকামিতায় সামরিক শাসককে মোকাবেলায় এগিয়ে আসেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন অবস্থাতেই এগিয়ে যেতে থাকে। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
এই গণঅভ্যুত্থানধর্মী আন্দোলন অনেক উত্থান-পতন শেষে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটায়। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হলে কাগজে-কলমে স্বৈরাচার মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ।
১৯৯৩ সালে পূর্ববর্তী সামরিক সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী উপদেষ্টা সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’ প্রবর্তন করেন। শফিক রেহমান তার ম্যাগাজিন ‘যায় যায় দিন’-এ পরকীয়া প্রেমের আখ্যান ‘দিনের পর দিন’ কলামে ‘মিলা ও মইনের’ টেলিফোনে কথোপকথনের ভালোবাসার মূর্তরূপ ধারণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বেছে নেয়। শফিক রেহমানের দুরভিসন্ধি ছিল- যেকোনো প্রকারে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’কে দিকহীন করা। তার বিকলাঙ্গ চিন্তা যখন ‘ভালোবাসা দিবস’ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে তার অনেক আগে থেকেই বাঙালিরা লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরে পয়লা ফাল্গুনকে বরণ করে ভালোবাসা দিবস হিসেবে। একই ইভেন্ট দুই নামে একটু বেখাপ্পা লাগে বলে তিনি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ প্রপোজ করেন, যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ অন্য অর্থে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালিত হয়।
এখন ১৪ ফেব্রুয়ারি যে ‘ভালোবাসা দিবস’ পালিত হয়, এর পেছনের ইতিহাস খানিকটা ভিন্ন রকম। ২৭০ সালে রোমের শাসক ছিলেন রাজা ক্লডিয়াস-২। তখন রাজ্যে চলছিল সুশাসনের অভাব, আইনের অপশাসন, অপশিক্ষা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও কর বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কালাকানুন। এতে প্রজাকুল ফুঁসছিল। রাজা তার সুশাসন ফিরিয়ে রাখার জন্য রাজদরবারে তরুণ-যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর যুবকদের দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কারণ, রাজা বিশ্বাস করতেন বিয়ে মানুষকে দুর্বল ও কাপুরুষ করে। বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠল।
এ সময় যাজক সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালোবাসার বন্ধু’ হিসেবে; কিন্তু তাকে রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে আটক করা হলো। জেলে থাকাকালীন ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় হয় জেলরক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সাথে। আস্ট্রেরিয়াস জানতেন ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীকালে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।
এতে মেয়েটির সাথে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাজা তার এই আধ্যাত্মিকতার সংবাদ শুনে তাকে রাজদরবারে ডেকে পাঠান ও তাকে রাজকার্যে সহযোগিতার জন্য বলেন; কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগিতায় অস্বীকৃতি জানান।
এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের ঠিক আগের মুহূর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লিখেন ও শেষাংশে বিদায় সম্ভাষণে লেখা হয় ‘From your Valentine’। এটি ছিল এমন কয়েকটি শব্দ, যা হৃদয়কে বিষাদগ্রাহ্য করে। অতঃপর ২৭০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দিনটিকে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
আমাদের ছাত্র-জনতার বীরত্বের গল্পটি এরকম নয়। সেটি গৌরবের। বিজয়ের। গণতন্ত্রের। অপশাসন বিরোধিতার ও গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ের। ওই দিন ঢাকার রাজপথে লড়াকু ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে নেমেছিল- স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল। কেঁপে উঠেছিল রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ। এক স্বৈরশাসকের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিল জাফর, মোজাম্মেল, জয়নাল, দীপালী, আইউব, কাঞ্চনসহ অনেকে।
ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না মফস্বলের ছাত্র সমাজ, তবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে দেশের সব ছোট-বড় শহরে ছাত্ররা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সারাদেশের ছাত্রসমাজ ভাবত- ক’দিন পরই আর এক মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবে। দেশ স্বাধীন হবে! সেই ক’দিন আর কোনো দিনও আসেনি। আমাদের সেই গৌরবের স্বৈরাচার-বিরোধিতা, সেই অগ্নিগর্ভ অভ্যুত্থান, কখন যে চোরাবালিতে পথ হারিয়েছে বুঝতে পারিনি। আমাদের পয়লা ফাগুন তো ছিলই। আমরা সেদিনই আবীরে রাঙা হতাম, বাসন্তী রঙে সর্ষেফুলি হতাম; কিন্তু লাল গোলাপ নিয়ে ভণ্ডামি করা ওই সাংবাদিক বিদেশ থেকে ভ্যালেন্টাইনস ডে আমদানি করে স্বৈরাচার-বিরোধী দিবসকেও কলঙ্কিত করেছেন।
তথাকথিত ভালোবাসা দিবসের ফুলগুলো গাছেই থাকুক। আপনি বরং উল্লাস কিংবা আরোপিত শোক কোনোটিই না করে স্মৃতিমন্থন করুন। যে স্মৃতি হয়তো আপনাকে দ্রোহী করে তুলতে পারে। সে সময় অসংগঠিত জনসাধারণের অগ্রণী প্রতিভূ হিসেবে ছাত্রসমাজ বুক চিতিয়ে রাজপথে নেমে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিত; তারপরও গণতন্ত্রের অধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস করতো না। আর ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হানা হয়। ছাত্রসমাজের মুখের সামনে ভালোবাসাবাসি আর প্রেম-নৈবেদ্যর মূলা ঝুলিয়ে একটি শ্রেণি স্বৈরাচারের দালালি করে আখের গুছিয়েছে।
আর বাংলাদেশের লড়াকু ছাত্রসমাজকে বিকলাঙ্গ বানানোর দুরভিসন্ধি হিসেবে এই বিকৃত ভালোবাসা দিবস বর্জন করে দেশের সচেতন ছাত্রসমাজ ফের অসংগঠিত অসচেতন জনতাকে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ে রাজপথে থাকুক।