মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা (শেষ পর্ব)

মনজুরুল হক
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৭

ঢাকায় ২৫ মার্চের ক্রাকডাউনের পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাঙালিরা তাৎক্ষণিকভাবে কৃত কর্তব্য নির্ণয় করতে পারেনি। একরকম দিশেহারা অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। নেতৃস্থানীয় কোনো অবস্থান থেকে কোনো রকম দিক-নির্দেশনা আসেনি।
যদিও ৭ মার্চের ভাষণে বলা ছিল- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আমি যদি হুকুম দিবার না পারি, তোমরা সব বন্ধ করে দেবে’- কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে ঠিকই জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কোনো নেতার হুকুমের অপেক্ষায় ছিল না।
এর পরপরই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে নির্দেশনা পেয়ে পার্টির প্রভাবাধীন জেলাগুলোর সবখানেই নেতা-কর্মীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা ছিল উল্লেখযোগ্য অঞ্চল। এর মধ্যে যশোর ছিল প্রধান। কেবল খুলনার পার্টিতেই শেষ দিকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ওঠে। সেটি পরে তারা আত্মসমালোচনাও করেছিলেন। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তাদের অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন। ইপিসিপি (এম-এল)-এর কর্মীরা যশোর, কুষ্টিয়ায় ২৫ মার্চের পরপরই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ও সেই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোন তাগিদে বামপন্থীরা এই যুদ্ধে গিয়েছিল তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সবাই জানেন।
মার্চের পরে একটি দলিল উপস্থাপন করেছিলেন কমরেড আবদুল হক ও অজয় ভট্টাচার্য, অন্যটি দিয়েছিলেন কমরেড তোয়াহা ও কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার। এসব কোনো দলিলেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করা হয়নি। কমরেড আবদুল হক আগস্ট মাসে প্রথমে খুলনা গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যুদ্ধের পক্ষেই একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, যশোরের আর খুলনার লাইন যখন মিলে গেছে, তাদের সঙ্গে মিলে আপনারা একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করার চেষ্টা করেন। এরপর তিনি নড়াইলের পেড়লীতে আসেন, সেখানে বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন। তখনো তিনি সেই একই আঞ্চলিক কমিটির প্রস্তাব করেছিলেন। যদিও এটি আর কেউ কার্যকর করেনি। তিনি তখন দুই দলিল সম্পর্কে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন; কিন্তু ইপিসিপি (এম-এল) যশোর জেলা কমিটি তাকে জানায়, ‘আমরা এখন যুদ্ধের ভেতর আছি। এই মুহূর্তে পার্টির দুই দলিল নিয়ে আলোচনার অবস্থায় আমরা নেই।‘
তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন; কিন্তু কোনো কায়দা করে বা ঘুরিয়ে পেঁচিয়েও তিনি বলেননি যে, আপনারা যুদ্ধে অংশ নেবেন না। সুতরাং আবদুল হকের যে তৎপরতা তা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল না। তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিপ্লব- দুই লাইন কখনো ত্যাগ করেননি।
প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেক জায়গাতেই মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যৌথ ভূমিকা পালিত হয়েছে। আওয়ামী-ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ দেশত্যাগ করার পর পার্টি প্রভাবিত এলাকায় যারা থেকেছেন, তাদের সঙ্গে বামপন্থীদের তেমন কোনো বিরোধ হয়নি। পরবর্তীতে ঠিক হয় মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধেও ইপিসিপি (এম-এল), সিপিইবি (এম-এল) সংঘাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। তারা দেশের অভ্যন্তরে সংগঠিতভাবে প্রবেশ করার আগেই বামপন্থীরা সংবাদ পায়; ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর দলবল উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্রসহ দেশে ফেরৎ আসছে। যুদ্ধের বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি হয়ে বামপন্থীরা ঠিক করেছিল, একই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা এবং মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া একেবারেই সঙ্গত হবে না। তাছাড়া মুক্তিবাহিনী-মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতিও তাদের ছিল না; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা নিশ্চিত সংবাদ পেয়েছিল মুক্তি ও মুজিব বাহিনী তাদের ধ্বংস করার জন্য সামরিক অভিযান চালাবে এবং কিছু দিনের মধ্যেই তারা হত্যাকাণ্ড শুরু করে দেয়। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থীরা আত্মরক্ষাামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। মহম্মদপুর-নড়াইল-লোহাগড়া বা পেড়লী এলাকায় মুক্তিবাহিনী-মুজিব বাহিনীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ইপিসিপি (এম-এল) পার্টির নেতাকর্মীদের ছিল দীর্ঘ দিনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। প্রথমে কেউ ভাবতেই পারেনি তারা বামপন্থীদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেবে এবং হত্যাকাণ্ড চালাবে।
তবুও দীর্ঘ সময় ধরে এ অভিযোগ শোনানো হচ্ছে; ‘আওয়ামী লীগ ও তাদের কাছাকাছি দল ছাড়া অন্যরা, বিশেষ করে নকশালরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে।’ বাস্তবে এটি একটি মিথ্যা অপপ্রচার।
ইপিসিপি (এম-এল) এর মতো অতটা শক্তি এবং দৃঢ় অবস্থান না থাকলেও উত্তরাঞ্চলে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন ধারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, আত্রাই, ঈশ্বরদীর ব্যাপক এলাকাজুড়ে মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- কমরেড মনিরুজ্জামান তাঁরা, মোফাখখার চৌধুরী, কামরুল মাস্টার, মধুবাবু, শিহাব শাহীন, মন্টু দাস প্রমুখ। এরা ছোট ছোট গেরিলা দল বা গ্রুপ গঠন করে চোরাগুপ্তা হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে রাখত। কিংবদন্তি আছে; কামরুল মাস্টার অপারেশন শেষে নিজেদের ডেরায় ফিরে এলে গুলির খোসা গোনা হতো! বিশ্বাস করা হতো কামরুল মাস্টার যে কয়টা গুলির খোসা জমা দেবে, সেই কয়টি পাকিস্তানি সেনা মারা গেছে নিশ্চিত!
ইপিসিপি (এম-এল) একাত্তরের যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে শোনা যায়। দেশে এ যাবতকালে যতগুলো পার্টি ক্ষমতাসীন ছিল সবাই ওই একই অভিযোগ করে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগ ওঠার পরপরই অত্যাবশকীয় হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে ব্যাখ্যা হাজির করা।
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত ইপিসিপি (এম-এল) কিছু ইস্তেহার প্রকাশ করে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে।
আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে পেছন ফিরে এই উপলব্ধি আসে- সেই উত্তাল একাত্তরে সিপিবি-ন্যাপ যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধত, তাহলে তথাকথিত ‘মস্কোপন্থী’-পিকিংপন্থী’ উভয় পক্ষ মিলে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে দীর্ঘমেয়াদি জনযুদ্ধ গড়ে তুলতে পারত, তাহলে আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সর্বহারা শ্রেণিকে পথ ও মতের দিক-নির্দেশনার অভাবে খাবি খেতে হতো না।