
নববর্ষের আবাহন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সদস্যরাও এই নববর্ষের লৌকিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নতুন বছর কর্মজীবী পরিবারেরও শাশ্বত আনন্দের উৎস। বাংলাদেশের আনন্দপ্রিয় মানুষ শত দুঃখ-কষ্ট পেরিয়েও সুন্দর আগামীর স্বপ্নে আবহমানকাল থেকে বিভোর থাকতে অভ্যস্ত। তাই নববর্ষের আবেদন দিনে দিনে পল্লবিত হয়েছে এদেশে।
গ্রামীণ মানুষ নববর্ষকে আপন করেছে যুগ যুগ ধরে। এতে আড়ম্বর ছিল না; কিন্তু হৃদয়ের উত্তাপও কখনো স্তিমিত থাকেনি। শহুরে মানুষ এতে যুক্ত হতে গিয়েই শুরু হয়েছে বিপত্তি। এরা নতুন ফসলের ঘ্রাণ আর আনন্দের সঙ্গে পরিচিত নয়। যারা পরিচিত তারা শিকড়ের পরিচিতি উন্মোচনের ভয়ে নীরবে এড়িয়ে যেতে চায়। শিক্ষার মাধ্যমে চাকরি বা অর্থ হাতানোর মাধ্যমে ধনী সাব্যস্ত হওয়া মানুষ অতীতকে রোমন্থনে ভয় পায়। পাছে বিবর্ণ অতীত দাঁত বের করে হাসে! এরা বাংলা নতুন বছরকে গ্রেগরিয়ান নতুন বছরের মতো পালন করতে হবে ভেবে কুণ্ঠিত হয়। মধ্যবিত্তের পালাবদলে সুখের মুখদেখা এসব শহুরে মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে এখন আর সরাসরি জড়িত নয়। এ কারণে খামারের মুরগির মতো দিনযাপন ও অর্থ সঞ্চয়ে যত আগ্রহ এবং ঔৎসুক্য, জীবন বোধ ও দর্শন নিয়ে তেমন প্রত্যাশা তাদের নেই। অতীত নিয়ে এদের বেদনা প্রবল। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কথা এরা বিস্মৃত অনেকে। শহুরে এই তথাকথিত অভিবাসীরা নববর্ষকে পরিত্যক্ত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে বর্জনেই বেশি আগ্রহী।
বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষের উদ্ভব নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। নববর্ষে পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা অতীতে মানুষ জানতো পঞ্জিকা থেকে। বলা যেতে পারে, বর্তমান উন্নয়ন পরিকল্পনার উৎস তৎকালীন পঞ্জিকা। এতে বছরের বৃষ্টি গণনা থেকে শুরু করে নদীর জোয়ার ভাটাসহ সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের তথ্যাবলি পর্যন্ত থাকে। এটি গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারীদের জন্য একটি পারিবারিক ডাইরি হিসেবেও কাজ করত। আধুনিক ক্যালেন্ডারের এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প।
সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের সময় বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা বলে কেউ কেউ বলেন। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ে এতে পরিবর্তন আনেন। মুঘল সাম্রাজ্যে হিজরি সন অনুযায়ী কৃষি খাজনা আদায়ের প্রচলন ছিল; কিন্তু এটি চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে দিন গণনা সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। আকবরের মন্ত্রী পণ্ডিত আবুল ফজলের মতে সৌর ৩০ বছর চান্দ্র ৩১ বছরের সমান। তাই হিজরি সন ফসলের খাজনা আদায়ের উপযোগী নয়। এর পরিবর্তে নতুন সনের পরিকল্পনা করা যায়। রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সৌর ও চান্দ্র সনের ভিত্তিতে এই ফসলি সনের গণনা শুরু করেন। পরবর্তীতে এটি বঙ্গাব্দ হিসেবে পরিচিত হয়।
যদিও বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব সম্রাট আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বের দুটি শিব মন্দিরে পাওয়া গেছে, যাতে অনুমিত হয় বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের সময়ের আগেও বাংলায় ছিল। বিশেষ করে মাসগুলোর নাম নক্ষত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এ বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করেছে। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ হয়।
নববর্ষের সঙ্গে বর্ষপঞ্জিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে তৎকালীন রাজা বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে বর্ষের নাম রাখা হয় বিক্রম। ফলে ভারতের অনেক অঞ্চল ও নেপালে বিক্রমাদিত্যের সময়কে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাব হয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। যদিও বাংলায় দিনপঞ্জির শুরু ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে। ধারণা করা হয়, রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে প্রাচীনতম পঞ্জিকা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অবধি বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যেত।
১৯৫২ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা পুনর্গঠন বিভাগ দেশজুড়ে ৩০টিরও বেশি সুসংগঠিত পঞ্জিকাকে চিহ্নিত করেছিল। এদের প্রত্যেকটিই সূর্য সিদ্ধান্তের পৃথক পৃথক সংস্করণ। এগুলো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হতো। ভারতে বহুল প্রচলিত দুটি পঞ্জিকার মধ্যে বিক্রম সংবৎ বর্তমানে নেপালের জাতীয় পঞ্জিকা এবং এটি ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। শালিবাহন বা শক সংবৎ অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও গোয়ায় প্রচলিত। ৫৬ খিস্টপূর্বাব্দে উজ্জয়িনীর সম্রাট বিক্রমাদিত্য শকদের সঙ্গে যুদ্ধে তার বিজয় উপলক্ষ্যে বিক্রম সংবৎ চালু করেন। ঠিক একইভাবে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী শকদের পরাজিত করে শক সংবৎ চালু করেন।
বিক্রম ও শালিবাহন- উভয় পঞ্জিকাই চান্দ্র-সৌর পঞ্জিকা, এতে বছর বারোটি মাসে বিভক্ত, আবার প্রতিটি মাস দুটি পক্ষে বিভক্ত- শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ; প্রথম পক্ষে চন্দ্রকলার বৃদ্ধি হয়, অপর পক্ষে ক্ষয় হয়। অর্থাৎ, যে পক্ষ অমাবস্যা দিয়ে শুরু ও পূর্ণিমা দিয়ে শেষ হয়, সেটি হয় শুক্লপক্ষ, বিপরীতক্রমে পূর্ণিমা দিয়ে শুরু হয়ে অমাবস্যায় শেষ হলে, পক্ষের নাম হয় কৃষ্ণপক্ষ।
বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশকরা প্রচলিত দুটি পদ্ধতি অর্থাৎ দৃক সিদ্ধান্ত ও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত-এর যেকোনো একটি অনুসরণ করে থাকেন। বেলুড় মঠ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার প্রতি অনুগত ছিলেন। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ একজন জ্যোতিষী ছিলেন, যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আরও বিজ্ঞানসম্মত গণনা ও উপস্থাপনার জন্য এই পঞ্জিকা অনুসরণ করবেন।
গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা ১৬ শতাব্দীতে অনুসরণ রঘুনন্দন রচিত অষ্টবিংশতিতত্ত্ব ১৫০০ বছর বয়সী জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে সূর্যসিদ্ধান্ত। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, সূর্যসিদ্ধান্তের দেওয়া গ্রহের অবস্থানের একটি ১৮৯০ সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট। প্রথম দিকে হাতে লেখা পঞ্জিকা বাজারজাত করা হতো। তালপাতায় লেখা পঞ্জিকাও তখন ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে বিশ্বম্ভর আবার হাতে লেখা বই আকারে পঞ্জিকা প্রকাশের কাজ শুরু করেছিলেন। মুদ্রিত সংস্করণটি ১৮৬৯ সালে এসেছিল। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ১৮৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
জ্যোতির্বিদ মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পঞ্জিকা অধ্যায়ন করার পরে প্রচলিতভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রকৃত এবং জ্যোতিষীয় অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিক পাঠ অনুসারে পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য ব্যক্তিরাও ছিলেন যাঁরা পঞ্জিকার বৈজ্ঞানিক পুনর্বিবেচনার পদ্ধতিকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৫২ সালে পঞ্জিকার একটি বড় সংশোধনী ভারত সরকারের নেতৃত্বে গৃহীত হয়েছিল।
পঞ্জিকা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। ‘ডিরেক্টরি পঞ্জিকা’ (ম্যাগনাম ওপাস) ‘পূর্ণ পঞ্জিকা’ (পাতলা সংস্করণ) এবং ‘অর্ধ পঞ্জিকা’ (সংক্ষিপ্ত সংস্করণ) এবং ‘পকেট পঞ্জিকা’-এর মতো রূপগুলোর আলাদা আলাদা দাম রয়েছে।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গে প্রকাশিত জনপ্রিয় পঞ্জিকার অন্যতম হচ্ছে বেণী মাধব শীলের পঞ্জিকা। বিভিন্ন আকারে এটি প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া রয়েছে মদন গুপ্তের পঞ্জিকা। বেশ কিছু ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা যথা- পিএম, বাকচি, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকারও বড় বাজার রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। পঞ্জিকা প্রকাশনায় মুদ্রণ শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পৃষ্ঠাগুলো মোটা নিউজপ্রিন্ট থেকে মসৃণ। অফসেট মুদ্রণ ও রঙিন চিত্রের ব্যবহার পঞ্জিকার পুরনো চেহারায় পরিবর্তন এনেছে। পঞ্জিকার বাজারও খুব একটা ছোট নয়। উপস্থাপন ও সামগ্রীর রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়ও বেড়েছে এবং ২০০৭ এর এক হিসেবে পঞ্জিকার সামগ্রিক বার্ষিক বাজারটি প্রায় ২০ লাখ কপির। বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব পঞ্জিকা ব্যবহত হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সাল থেকে এটি ঢাকার লোকনাথ বুক এজেন্সি সরবরাহ করে আসছে। এর ফুল ও হাফ সংস্করণও আছে। এ ছাড়া নবযুগ পঞ্জিকা দীর্ঘদিন যাবত প্রকাশিত হচ্ছে। সুদর্শন নামে একটি পঞ্জিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। খুলনা থেকেও বিশুদ্ধ সনাতন পঞ্জিকা নামে একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।
ঢাকার স্বামীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম ও মন্দির থেকে তিন বছর যাবত প্রকাশিত হচ্ছে জয় বাবা লোকনাথ রঙিন ফুল পঞ্জিকা। পুরো অফসেটে ছাপা এই পঞ্জিকায় নিত্যদিনের আবশ্যক তথ্য ও রঙিন ছবি ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করে তলার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া রয়েছে মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা।
পঞ্জিকা সাধারণত প্রতি বাংলা সনে ফাল্গুন মাসের শেষার্ধে বাজারে আসতে শুরু করে। বাংলাবাজার পঞ্জিকার ঘাঁটি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের লাঙলবন্ধ স্নান মেলাসহ অনুরূপমেলা ও মন্দির সংলগ্ন দোকানসমূহে পঞ্জিকা পাওয়া যায়।
সনাতন হিন্দুদের পূজাপার্বণ ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পঞ্জিকায় বর্ণিত তিথি অনুসরণক্রমে পরিচালিত হয়। এই গণনা বিজ্ঞানসম্মত বিধায় রমজান মাসের ইফতার ও সেহরির নির্ভুল সময় নির্ধারণে পঞ্জিকার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। এ ছাড়া পঞ্জিকাকে সাধারণ মানুষের তথ্য ভাণ্ডার হিসেবেও কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে সরকারি সেবা ও উন্নয়নের সেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে।
দেশে শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমরা মোবাইল ফোনকে শিক্ষা ও তথ্য আদান-প্রদানে কার্যকরভাবে ব্যবহার করছি। মোবাইল ফোনের পরিপূরক তথ্যভাণ্ডার হিসেবে পঞ্জিকাকে সুলভে গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে দিতে পারলে তথ্যসমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী গঠনে আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত করা অসম্ভব কিছু নয়। আমরা নতুন দিনের পঞ্জিকার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করতে পারি।